দেবব্রত বিশ্বাস : ঝর্ণাধারার মতো তাঁর গানের প্রবাহ

সুদেব সিংহ- সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন— দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় রবীন্দ্রনাথের যে-গান একবার কানে আসে, আর কারো গলায় সেই গান যেন কানে ওঠেই না। বিশ্বখ্যাত এই চিত্রপরিচালক তাঁর সাংগীতিক বোধ ও বিস্ময়কর কৃতিত্বের জন্যে দেশনন্দিত। সত্যজিৎবাবুর এই কথা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বলিষ্ঠ আকারে আমাদের কাছে নিয়ত উপস্থিত হচ্ছে। প্রযুক্তির কত রকমফের ঘটেই চলেছে। কালের গতিকে যেন থামিয়ে দিয়ে ঝর্ণাধারার অনন্ত প্রবাহের মতো সতত সচল দেবব্রত বিশ্বাসের গান। 

দেবব্রত বিশ্বাসের প্রয়াণের পর ৪২ বছর কেটে গেল। বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড তাঁর গানে আপত্তি তুলেছিলেন। প্রধানত, ১৯৬৯ সালে তাঁর রেকর্ড প্রকাশের গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ এই ঘটনার পরও ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। আজ এই দাপুটে ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগেও মানুষের হৃদয়ে তাঁর ছবি অমলিন। অন্ধের স্পর্শের মতো জেগে রয়েছে দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠ। তিনি আমাদের চিরবন্ধু, চিরনির্ভর। অথচ বার বার প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে দেবব্রত বিশ্বাসকে।

আপাতত আমরা ফিরে যাই মিউজিক বোর্ডের সূচনালগ্নে, ১৯৪২ সালে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী, অনাদিকুমার ঘোষদস্তিদার, শৈলজারঞ্জন মজুমদার এবং শান্তিদেব ঘোষকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল মিউজিক বোর্ড। প্রধানত, অনাদি দস্তিদারই পরীক্ষক ছিলেন। চল্লিশের দশকের মধ্যভাগে, সম্ভবত ১৯৪৪ সালে প্রথম মিউজিক বোর্ড আটকে দেয় দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া ‘তুমি রবে নীরবে’। গীতবিতানে রয়েছে- ‘মম দুঃখ বেদন, মম সফল স্বপন’, দেবব্রত বিশ্বাস গেয়েছেন- ‘মম দুঃখ বেদন, মম সকল স্বপন’। অনাদিবাবু গান আটকে দেন।

দেবব্রত বিশ্বাস আচার্য পুলিনবিহারী সেনের দ্বারস্থ হন। কারণ, পুলিনবিহারীর সহায়তায় দেবব্রত বিশ্বাস তৎকালীন বীণাবাদিনী পত্রিকা ও আনন্দসংগীত পত্রিকা থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি নিজের খাতায় লিখে নিতেন। এই প্রসঙ্গে দেবব্রত বিশ্বাস বলেছেন, পুলিনদাকে ওখানকার লাইব্রেরি থেকে পুরনো আনন্দসংগীত পত্রিকা এবং বীণাবাদিনী পত্রিকাগুলি আনিয়ে দিতে অনুরোধ করতাম। পুলিনদা সেই বাঁধানো পত্রিকাগুলি আমার জন্যে গ্রন্থ বিভাগের বাড়িতে, তিনি যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘরে আনিয়ে রাখতেন।

আমি প্রায় রাত দুটো পর্যন্ত জেগে ওইসব পত্রিকায় বহু বছর পূর্বে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপিগুলি আমার খাতায় লিখে নিতাম। এই গানটিও তিনি বীণাবাদিনী অনুসরণেই গেয়েছেন। অনাদিবাবু বললেন, মুদ্রণ প্রমাদ। দেবব্রতর পাল্টা যুক্তি, তাহলে এক বছরের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ শুদ্ধিপত্র প্রকাশ করলেন না কেন? অন্যান্য গানের ক্ষেত্রে একাধিকবার যা দেখা গেছে। ইতিমধ্যে ইন্দিরা দেবী জানিয়ে দিলেন, তাঁর খাতাতেও ‘সকল স্বপন’ রয়েছে। এবারে অনাদিকুমার মেনে নেন।

রবীন্দ্র শতবর্ষে, অর্থাৎ ১৯৬১ সালে, দেবব্রত বিশ্বাসের রেকর্ড বিক্রি তখন তুঙ্গে। ঠিক এই সময়েই মিউজিক বোর্ড নতুন আকার গ্রহণ করে। ইতিহাসবিদ প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, আইনবিদ নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, শান্তিদেব ঘোষ, রণজিৎ রায়, এস এ মাসুদ, সুধীররঞ্জন দাস এবং রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অরুণ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে গড়ে উঠল মিউজিক বোর্ড ট্রাস্টি। এঁদের মধ্যে সংগীতের দিক থেকে একজনই- শান্তিদেব ঘোষ। মিউজিক বোর্ডের নতুন পরীক্ষকরা নিযুক্ত হলেন। তাঁরা হলেন, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবিনয় রায় এবং নীলিমা সেন।

এই মিউজিক বোর্ডই প্রথম ১৯৬৪ সালে দেবব্রত বিশ্বাসের ‘এসেছিলে তবু আসো নাই’ গানটির প্রকাশে বাধা দিলেন। কিন্তু আশ্চর্য সৌজন্য দেখিয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র। তিনি সোজা দেবব্রত বিশ্বাসের ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ-এর বাড়িতে হাজির হলেন। বললেন, ‘চঞ্চল চরণ গেল ঘাসে ঘাসে’ অংশটিতে ‘চন’ শব্দে স্বরলিপি লঙ্ঘন হয়েছে। দেবব্রত বিশ্বাসের অনুরোধে সুচিত্রা মিত্র গানটি গাইলেন। দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর প্রিয় ‘দিদিমণি’কে স্বরলিপি খুলে দেখিয়ে দিলেন, তাঁরও স্বর বা নোট সঠিকভাবে প্রযুক্ত হয়নি। এবার এগিয়ে এলেন শান্তিদেব ঘোষ। লিখিতভাবে জানালেন, দেবব্রত বিশ্বাস যেভাবে গেয়েছেন সেভাবে সুর অবশ্যই হতে পারে।

কিন্তু ১৯৬৯ সালে মিউজিক বোর্ড গুরুতর আপত্তি তুলে বললেন, ‘Music accompaniment excessive, melodramatic,…’ ইত্যাদি। যে দুটি গানে তাঁরা আপত্তি করেছিলেন, সে দুটি গান হলো- ‘পুষ্প দিয়ে মারো যারে’ এবং ‘তোমার শেষের গানের রেশ নিয়ে কানে…’।

মিউজিক বোর্ড ১৯৬৯ সালের ২৫ জুলাই চিঠিটি পাঠান হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টকে। এই সংস্থার অনুরোধে দেবব্রত বিশ্বাস ১৬ আগস্ট ১৯৬৯ এ মিউজিক বোর্ডকে সুদীর্ঘ এক চিঠি লেখেন। কিন্তু কোনও উপায় বার হয়নি। এর পর হিন্দুস্তান রেকর্ডসের কর্ণধার চণ্ডীচরণ সাহার অনুরোধে দেবব্রত বিশ্বাস প্রায় ৭০টি গান রেকর্ড করেছিলেন। তার মধ্যেও না কি দশটি গান মিউজিক বোর্ড আটকে দেয়। এর পর দেবব্রত বিশ্বাস সিদ্ধান্ত নেন, চিরতরে রেকর্ডিং বন্ধ করে দেওয়ার। 

দেবব্রত বিশ্বাস প্রয়াত হন ১৯৮০ সালের ১৮ আগস্ট। জীবনের শেষ দশ বছর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের সঙ্গে লড়াই করেও তাঁকে বার বার মঞ্চে উপস্থিত হতে হয়েছে। কখনও স্নেহাংশুকান্ত আচার্য চৌধুরী বা কখনও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর অনুরোধে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বার বার তাঁকে অনুরোধ করেছেন মিটমাটের জন্য।

দেবব্রত বিশ্বাস সপাটে জানিয়েছেন, মাঝারিদের সঙ্গে আমি মিটমাট করি না। উত্তমকুমার তাঁর বাড়িতে জোড় হস্তে উপস্থিত হয়েছেন অনুষ্ঠানের জন্য। এই সময়ে দেবব্রত বিশ্বাস একটি গান গাইতেন- ‘গুরু তুমি দেইখ্যা গ্যেলা না/ তোমার সাধের বাগান পণ্ডিতেরা করল কবরস্তান/ একদিকে রইল গজু অন্যদিকে মনা/ তুমি গুরু দেইখ্যা গ্যেলা না…’। গজু এবং মনা কাদের ডাকনাম এটা সহৃদয়ে পাঠক নিশ্চয়ই অনুসন্ধান করবেন।

দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিন ৬ ভাদ্র (১৯১১ সালের ২২ আগস্ট)।

About Unlive

Check Also

ranji trophy

Ranji Trophy: রঞ্জি ট্রফির বাংলা – কেরল ম‍্যাচ ড্র! ইশান পোড়েলের দুরন্ত বোলিং নিল ৬ উইকেট

ইউ এন লাইভ নিউজ: প্রত‍্যাশিত ভাবেই রঞ্জি ট্রফির বাংলা – কেরল ম‍্যাচ ড্র হয়ে গেল। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *