স্বাতী চট্টোপাধ্যায়:- মাত্র ঘণ্টা খানেকের রাস্তা পার করে এই চড়াই কেল্লায় উঠে কার্যত হাঁফিয়ে উঠেছিলেন মিতাদি। হাঁটার কারণে নয়। স্রেফ উঁচু এবং তাঁর আবার বাতের সমস্যা। সুচরিতাদিকে বললাম, হাতে সময় আছে ভালো করে ঘুরে নিন।
এখানে তিনটি জলাধার আছে। যুদ্ধের সময় যাতে জলসঙ্কট দেখা না দেয়, তাই এই জলাধারগুলি তৈরি করা হয়। সেগুলো ভালো করে দেখুন, সেই সঙ্গে কেল্লার স্থাপত্য, অন্দরমহলে যাওয়ার পথ সবই অনবদ্য, আমি একটু কেল্লার দিকটা ঘুরে আসি। অন্যদিকে গৌতমদাকে মানে আমাদের ট্যুর ম্যানেজারকে বললাম, খাবারটা অ্যারেঞ্জ করে আমাকে ফোন করে দিও।
সত্যি এই গিরি কত ইতিহাসের সাক্ষী। আর এই গিরিতেই আটকে আছে এক অভিশপ্ত আত্মার গাথা। অশ্বত্থামার কথা আগেই বলেছি। এটাতো পৌরাণিক কথা, মহাভারতের কথা। কিন্তু আমাদের গাড়ির চালক আসার সময় বললেন, এই গিরিতেই প্রায় দেখা যায় মহাভারত খ্যাত বীর অশ্বত্থামাকে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পার করেও এখনও তিনি জীবিত।
যুদ্ধান্তে কপালে মণিক্ষত শরীর নিয়ে এখনও তিনি মুক্তি অপেক্ষায়। এখনও তিনি শিববন্দনায় রত। স্থানীয়দের জনশ্রুতি, সন্ধের পর এই গিরি প্রান্তরে অনেকেই পথ হারান, দিশাহীন হয়ে পড়েন অনেকে। এমন কোনও সঙ্কটঘন মুহূর্তেই, কোনও এক অশরীরি আধো আলোছায়ায় মিশে থাকা ঋষিতুল্য এই মানুষ পথ দেখান।
আরও পড়ুন- হারিয়ে যাচ্ছে ভারতের অদ্বিতীয় ফুলের ভাণ্ডার ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স’
চারপাশ প্রশস্ত পাহাড়ি জঙ্গল। তার মাঝে এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ, ইতিহাস, বহমান বিধ্বংস সভ্যতার প্রতীক অসিরগড় কেল্লা। হরি সিংজিকে বলেছিলাম পুরো টিমটাকে ঘুরিয়ে দেখান। আর আমি পা বাড়ালাম কেল্লার পূর্ব দিকে, গুপ্তেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে। এখানেই নাকি রোজ পুজো করতে আসেন অশ্বত্থামা।
খাড়া পাহাড়ের মধ্যে প্রায় একশো একর জায়গা জুড়ে রয়েছে কেল্লা। সময়ের হাত ধরে কখনও মুঘল, কখনও, হিন্দু, কখনও ইংরেজদের নির্মাণ শৈলির অবশিষ্ট চোখে পড়ে। কেল্লার প্রধান দরজা দিয়ে ঢুকলেই চেখে পড়বে সেনা ছাউনি। উত্তর দিকে রয়েছে ভগ্নপ্রায় জামা মসজিদ। তার আগে আর এক ছোট সেনা ছাউনি বারান্দা আর কেল্লার একদম মাঝামাঝি রানিমহল। দক্ষিণ দিকে কিছু ব্রিটিশদের নির্মাণ। আর পূর্ব দিকে, ফাঁসি ঘর। পুরো কেল্লাটা ঘুরতে সময় লাগবে বেশ কয়েক ঘণ্টা। তবে সবার আগে যে পথ ধরলাম তা পূর্ব দিকে গুপ্তেশ্বর শিবমন্দিরের দিকে, অশ্বত্থামার খোঁজে।
কেল্লার মূল ফটক থেকে আমি ধরলাম ডানদিকের রাস্তা। প্রকাণ্ড সব পাথর কেটে নির্মাণ করা হয়েছে দুর্ভেদ্য কেল্লার দেওয়াল। দেওয়াল বেয়ে আষ্ঠে পৃষ্টে গজিয়ে উঠেছে, বট অশ্বত্থের শিকড়। প্রকাণ্ড রাজ দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। একের পর এক দরজা। মাথা স্থির না রাখলে, কেল্লার ভুলভুলাইয়াতে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা কম নেই। তবু আমি একাই চললাম। না জনমানস নেই পূর্ব দিকটাই।
এক পাশে ভাঙা প্রাচীর আর এক পাশে আগাছায় ভরা জঙ্গল পেরিয়ে যতই এগোচ্ছি ততই দুরু দুরু করতে শুরু করেছে বুকের ভেতরটা। দিনের আলো স্পষ্ট থাকলেও সত্যি পরিবেশটা যথেষ্ট কঠিন। তার সঙ্গে ঝিঁঝি পোকার ডাক যেন কানের মধ্যে আঘাত হানছে। এবার এসে পড়লাম প্রকাণ্ড এ দরজার সামনে। দুটি বড় পাল্লার মাঝখানে একজন ব্যক্তি ঢোকার মতো ফাঁক রয়েছে। দরজার কয়েকটি ব্লক আবার ভাঙা। ওই ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
সিঁড়িগুলি ভ্গ্নপ্রায়, দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছে বটের শিকড়। ভেতরে ঢুতকেই যেন তাপমাত্রা হঠাৎ ৫ ডিগ্রি কমে গেল। শুরু হল আমার পা কাঁপা। বুকের ভেতরটাও যেমন কেমন হতে শুরু করল। তার সঙ্গে আবার যোগ দিল মেঘের গুরু গম্ভীর গর্জন। ওই আলো আঁধারি পরিবেশেই ভাঙা সিঁড়ির মধ্যে বসে পড়লাম।
আরও পড়ুন- দেখে নিন সেই জায়গা, যাখানে বিয়ে হয়েছিল রামভক্ত হনুমানের
শরীরটা হঠাৎই অসুস্থ হতে লাগল। উল্টো দিকে আরও একটি প্রকাণ্ড দরজা। ওপরের ছাদের একটা অংশ ভাঙা তার মধ্যে দিয়ে কিঞ্চিৎ আলো, আর তার বেশি বেশি ঢুকছে বৃষ্টির জল। সার্বিক পরিস্থিতি যেন আমাকে আরও দুর্বল করে তুললো। মনে হতে লাগল মাথার মধ্যে রক্তের স্রোত ক্রমেই শিথিল হচ্ছে।
ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করলাম। দুই ঢোক জল খেতেই শরীর আরও হাল্কা হয়ে উঠল। কেমন একটা ঘুম পেল। চোখের পলক দুটো এক করেছি, এমন সময়ই এক জলদগম্ভীর গলায় কে যেন ডেকে উঠল মা, একটু জল দেবে?
চোখের পাতা তখন প্রায় জবাব দিয়েছে, মাথা বনবন করে ঘুরছে, কষ্ট করে যতটা চোখের পাতাকে ওঠানো যায়, তেমন ভাবেই দেখার চেষ্টা করলাম, প্রায় দশ ফুট দূরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রকাণ্ড এক শীর্ণকায় ব্যক্তি। সাদা জট ধরা চুল, লম্বা দাড়ি ও গোঁফ। কপাল ফুঁড়ে ইন্দ্রবিদ্ধা, বিসর্পিকা ঘা বাসা জমিয়েছে।
পরনে রাজপুতি ধুতি, শরীরে অর্ধ তীর্যক তনু সাদা কাপড়। চওড়া কাঁধ, হাড়গুলি যেন বেরিয়ে আসছে। ডান পায়ে বালা, বাঁ হাতে কাঠের দণ্ডি একটি কমণ্ডলু। ডান হাতের আঙুলগুলি কোড় রোগে ক্ষয়ে গিয়েছে। কেমন একটা দুর্গন্ধ আসছে তাঁর শরীর থেকে।
কথা বলার অবস্থায় ছিলাম না আমি…প্রায় ঘোরে ছিলাম। তবু জিজ্ঞেস করলাম আপনি কে?
তিনি বললেন, আমি। আমি এক অহং। দেবাদিদেব মহাদেবের বরপ্রাপ্ত, দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা। আমার একটু জল দেবে?
কথাটা যেন গমগমিয়ে বেজে উঠল কানে। সারা শরীর তখন যেন বনবন করে ঘুরছে। কালো মেঘের কোল থেকে নেমে আসছে বৃষ্টি, আর তার প্লাবনে যেন আমার ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
পুরাণে বর্ণিত সাত চিরঞ্জীবির এক তিনি, মহাভারতের বীর যোদ্ধা আমার সামনে। কতশত প্রশ্ন আমার মনে তখন ঝড় তুলছে। কিন্তু বাক সরছে না। নিজেকেই তখন মনে হচ্ছিল কোনও বিধ্বংসী যুদ্ধক্ষেত্রের পরাজিত সৈনিক।
ঋষিতনুসম বিদেহী বলে উঠলেন, কুরুক্ষেত্রের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ দেখেছি, দ্বাপর যুগ থেকে অভিশপ্ত আমি…আমার এই চারণভূমি, ঋষি ব্যাসদেবের তপোভূমিতে কত বিধ্বংসী যুদ্ধ দেখেছি। কত হাহাকার, কত রক্তপাত, উল্লাস, ক্ষমতায় অসীন থাকার জন্য ছল, ষড়যন্ত্র প্রত্যেক পর্বের অংশীদার আমি। সেই সময় কাল থেকে এই প্রথা রীতি, নীতি এখনও বহমান। আমি ব্রহ্মহত্যা করেছিলাম, তাই আমার আত্মা, আমার অহংই আমার মুক্তির পথে অন্তরায়।
পিতার মৃত্যু আমার কাছে অনভিপ্রেত ছিল, ক্রোধকে সংবরণ করতে পারিনি। অধর্মীদের জন্য আমি বিবেককে হারিয়েছিলাম। রাজধর্ম পালনে নিজের ধর্মকে ভুলেছিলাম। অস্ত্রবিদ্যায় শ্রেষ্ঠ ছিলাম, কিন্তু জরাগ্রস্থ শরীর থেকে মুক্তি পেয়ে পরমাত্মার সঙ্গে মিলে যাওয়ার শিক্ষা এখনও পাইনি। আমার শরীরের পচন এ বর্তমান সমাজের সমতুল।
দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, কিন্তু মুক্তি নেই। অর্জুন হেরে গেছে…শ্রীকৃষ্ণবাসুদেব হেরে গেছে…ধর্ম স্থাপনা করতে পারেননি তাঁরা। এখনও বেঁচে রয়েছেন দুর্যধন, অধর্মের হাত ধরে। তার নজির আমি দেখেছি, শতাব্দী থেকে শতাব্দী সময়কালে এই গিরি প্রান্তরে। এই দুর্গের আনাচে কানাচে রয়েছে বহু নারী, সৈন্য, রাজা, সুলতান, জায়গীরদের আত্মা…মুক্তির অপেক্ষায়। যুদ্ধপ্রিয় মানবজাতির আত্মা। ধর্ম রক্ষার জন্য চাই একমাত্র যুদ্ধ। চাই বিধর্মীদের হত্যা।
একটি বিকট শব্দে ঘুম ভাঙল…সারা শরীর কাঁপিয়ে। ভাঙা সিঁড়ির মাঝে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। দেখলাম মোবাইলটা বাজছে, ভাইব্রেটারসহ। গৌতমদার ফোন, বেলা তিনটে বাজে, অনেকবার ফোন করেছে। শুনলাম গাড়ির চালক হরি সিংও বেশ কিছু জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে আমায়। বৃষ্টির রেশ অনেকটা কমে গিয়েছে। গুপ্তেশ্বর মন্দিরের দিকে আর যাওয়া হল না…অগত্যা আবার মূল রাস্তার দিকে ফিরলাম।
খাওয়া দাওয়া সারলাম মিতাদিরা খুব বেশি কিছু দেখতে পারেননি। তবু কিছুটা দেখা গিয়েছে কেল্লার। বিকেল সাড়ে চারটে, হোটেলে ফেরার পথ ধরলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম বহু প্রশ্ন। স্থানীয়দের লৌকিক গল্পগাথা কি সত্যি? আমি কি স্বপ্ন দেখলাম নাকি, প্রত্যক্ষ করলাম বাসুদেবের অভিশাপপ্রাপ্ত দ্রোণপুত্রকে? তিনি ঠিক কী বলতে চাইলেন? ধর্ম, অধর্ম, ব্রহ্মহত্যা, হিংসা, ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার লোভের নামে? বেদে বলছে পরমেশ্বর একটাই…তিনি তাঁর আত্মার স্বরূপ পাঠিয়েছেন যুগ যুগ ধরে।
আরও পড়ুন- ভিনগ্রহ থেকে আসা সেই মানুষ, যে কাঁপিয়ে দিয়েছিল জাপানকে
আর সেই প্রক্রিয়া নিরন্তর ভাবে চলছে প্রতিটি সৃষ্টির হাত ধরে। সংসার রচনা করেছেন তিনি, ভালো মন্দের সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছেন মানবজাতির হাতে। তাহলে ? জানি না। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়তো আমার মেধার বাইরে। কিন্তু একটা নির্যাস পরিষ্কার, অভিশপ্ত, গলা, পচা শরীর থেকে মুক্তি পাওয়ার নিরন্তর সাধনা চালাচ্ছেন অশ্বত্থামা, কিন্তু আমরা এই দুর্গন্ধযুক্ত সমাজ থেকে আমাদের মুক্তি করতে পারছি কি? অতএব অশ্বত্থামাই আসলে আমাদের আত্মাতুল্য। উপাসনা করছি, শান্তির, প্রেমের আবার ধ্বংসেরও, হত্যারও।
Leave a Reply