নিউজ ডেস্ক: বড়দিন যেন সত্যিই বড় দিন। বছর শেষে এই দিন থেকেই শুরু হয় বর্ষবিদায় উৎসব। কলকাতা থেকে আনাচে কানাচে শহরতলি, সবাই মেতে ওঠেন আনন্দে। রাস্তায় এই সময় চারিদিকে শুধু আলো আর আলো। আলোর রোশনাই, ২৫ থেকে ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সেজে ওঠে শহর।
বড়দিনে সবচেয়ে বেশি ভিড় লক্ষ্য করা যায়, হুগলি জেলার ব্যান্ডেলে অবস্থিত ব্যান্ডেল চার্চে। আমরা সকলেই কম বেশি ব্যান্ডেল চার্চে গিয়েছি। কিন্তু, এই চার্চ গড়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে এক অজানা রহস্যময় কাহিনি। কীভাবে তৈরি হল এই ব্যান্ডেল চার্চ? ভাস্কো দা গামা ভারতের পশ্চিম উপকূলে পা রাখার প্রায় এক শতাব্দী পর, পর্তুগিজরা ভারতে এসে ঘাঁটি গড়ে। হুগলি নদী তীরে দ্রুত তাঁরা বসতি স্থাপন করেন। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি এলে, সব যুদ্ধে জয় করেন পর্তুগিজরাই।
১৫৭১ সালে মুঘল সম্রাট আকবর, তাঁদেরকে হুগলিতে শহর নির্মাণের অনুমতি দেন। এই সময় পর্তুগিজরা ক্যাথলিক ধর্মপ্রচার করার অনুমতি পায়। সেই সঙ্গে, গির্জা নির্মাণের অনুমতিও দেওয়া হয় তাঁদের। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধরে, বহু মানুষকে সেই সময় তাঁরা ক্যাথলিক ধর্মে, ধর্মান্তরিত করেন। এবং তাঁরাই তৈরি করেন বেসিলিকা অফ দ্য হোলি রসরি, যা আজকের দিনে ব্যান্ডেল চার্চ নামে পরিচিতি পায়।
তবে, এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে এই চার্চকে কেন্দ্র করে। পর্তুগিজরা হুগলিতে বসতি স্থাপন করলেও, তাঁদের লুটপাটে ভারতীয় সম্রাট মোটেই খুশি ছিলেন না। তখন সাল ১৬৩২। মুঘল সম্রাট শাহজাহান পর্তুগিজদের বসতি, হুগলি নদী তীরে বন্দরে (আজকের ব্যান্ডেলে) আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। সেই যুদ্ধে চূড়ান্ত ভাবে পরাস্ত হয় পর্তুগিজরা। বহু পর্তুগিজ ও ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান মারা যায়। পর্তুগিজদের দুর্গ ভেঙে দেয় মুঘলরা। পর্তুগিজ গভর্নর ও পাঁচ পাদরিকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।
প্রবীণ পাদরি জোয়ান ডে ক্রুজ ও চার হাজারের বেশি পর্তুগিজকে মুঘল রাজধানী আগ্রায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ডে ক্রুজকে মেরে একটি মত্ত হাতির সামনে ফেলে দেওয়া হয়, এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ওই মত্ত হাতিটি, ডে ক্রুজকে পিষে মারার পরিবর্তে, তাঁকে শুঁড়ে করে পিঠে বসিয়ে নেয়। অবশেষে, এই ঘটনায় হতবাক হয়ে যান শাহজাহান। তিনি ক্রুজ এবং বাকি বন্দীদের মুক্তি তো দেনই, পাশাপাশি ১৬৩৩ সালে ৭৭৭ একর জমি পর্তুগিজদের নিস্কর হিসেবে দান করেন।
ওই জমিতে নতুন করে গড়ে ওঠে চার্চ। এরপরেও নানারকমের অবাক করা ঘটনা ব্যান্ডেল চার্চে ঘটেছে। যুদ্ধের সময় মাতা মেরির একটি মূর্তি, হুগলি নদীতে ভেসে যাচ্ছিল। তা তুলে আনতে, একজন জলে ঝাঁপ দিলেও সেই মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়নি। কিন্তু নতুন করে গির্জা তৈরি হওয়ার সময় হঠাৎ করেই, পারে ভেসে ওঠে ওই মূর্তিটি। নাম দেওয়া হয় ‘আওয়ার লেডি অফ হ্যাপি ভয়েস’।
ব্যান্ডেল চার্চ নিয়ে অবাক করা ঘটনা রয়েছে আরও। গির্জা উদ্বোধনের সময় একটি জাহাজের পাল দেখতে পাওয়া যায়। শোনা যায়, কিছুদিন আগেই ওই জাহাজটি প্রবল ঝড়ের মুখে পড়েছিল। তবে, নাবিকরা সকলেই বেঁচে গিয়েছেন। দুর্ঘটনার মুখে পড়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি প্রথম যে গির্জা দেখবেন, সেখানেই জাহাজের মাস্তুলটি দান করবেন। আজও, ব্যান্ডেল চার্চে ঢোকার মুখেই সেই মাস্তুলটি দেখতে পাওয়া যায়। মাস্তুলকে আরেক কথায় বলা হয় ব্যান্ডেল। সেই থেকেই ওই গির্জার নামকরণ হয় ব্যান্ডেল চার্চ নামে। এবং ওই এলাকার নাম হয়ে ওঠে ব্যান্ডেল। এই মুহূর্তে, বড়দিনের মেজাজে, যেই চার্চ লোকের ভীড়ে পরিপূর্ণ।