ইউ এন লাইভ নিউজ: রবিবার রাতে এত সহজে তৃতীয় ট্রফি তাঁরা ঘরে তুলতে পারবেন এটা কি অতি থেকে অতীব কেকেআর সমর্থকও ভাবতে পেরেছিলেন? যেখানে আইপিএল মরশুমের সেরা আগ্রাসী দল ফাইনালে কলকাতার প্রতিপক্ষ। সেই দলে রয়েছেন অভিষেক শর্মা, ট্রেভিস হেড, হেনরিখ ক্লাসেন, প্যাট কামিন্সের মতো একের পর এক ধুরন্ধর ক্রিকেটার। তাঁদের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে ম্যাচ জিতে যাবে কেকেআর? তাও আবার আইপিএল ফাইনাল!
হ্যাঁ, সেটাই হল। চেপকে উড়ল বেগুনি আর সোনালি ঝড়। রবিবার রাত হল বেগুনি আর সোনালিময়। কলকাতা নাইট রাইডার্স একই মরশুমে তিনে তিনবার হারাল সানরাইজার্স হায়দরাবাদকে। বিন্দুমাত্র লড়াই দেখা গেল না হায়দরাবাদের তরফ থেকে। নিজেদের বোলারদের প্রতাপ ও হায়দরাবাদ ব্যাটসম্যানদের অসহায়তার ফায়দা তুলল নাইট ব্রিগেড। পেসার ও স্পিনারদের দাপটে আগে ব্যাট করে ১১৩ রানেই অল-আউট হয় হায়দরাবাদ। জবাবে কেকেআর সেই রান তুলে নিল মাত্র ১০.৩ ওভারে। ৮ উইকেটে জিতে গেল ২০২৪ আইপিএলের ফাইনাল। প্লে-অফে আরও একবার নিজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অর্ধশতরান করলেন ভেঙ্কটেশ আইয়ার। আইপিএলের ফাইনালে ইতিহাসে সবচেয়ে একপেশে ম্যাচ হল রবিবার। সেই ম্যাচেই দেখা গেল আইপিএল ফাইনালের ইতিহাসের সবচেয়ে কম স্কোর ১১৩-র।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, বিশ্বকাপের পর আইপিএল জিতে অধিনায়ক হিসাবে ট্রফির ‘হ্যাটট্রিক’ করতে পারলেন না প্যাট কামিন্স। টসে জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এবার হবে চুলচেরা বিশ্লেষণ। দলের ব্যাটসম্যানদের প্রতি ভরসা, বৃষ্টির ভ্রূকুটি, নাকি মাঠে পরের দিকে শিশির না পড়ার ইতিহাস— কোনটা তিনি ভেবেছিলেন বলা মুশকিল।
প্রথম কোয়ালিফায়ারে মিচেল স্টার্কের দ্বিতীয় বলেই স্টাম্প উড়ে গিয়েছিল খতরনাক ট্রেভিস হেডের। স্টার্কের বিরুদ্ধে তাঁর পরিসংখ্যানও ভাল নয়। তাই এই ম্যাচে ঝুঁকি না নিয়ে অভিষেক শর্মা স্ট্রাইক নিয়েছিলেন। কিন্তু এই ম্যাচে প্রথম ওভারেই মরশুমের অন্যতম সেরা বল করে অভিষেকের অফস্টাম্প উড়িয়ে দেন স্টার্ক। মাঝ পিচে পড়া বল বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। লাগে গিয়ে অফ স্টাম্পের ওপরে।
দ্বিতীয় ওভারে আবার সাফল্য পায় কলকাতা। ওভারে ষষ্ঠ বলেই হেডকে তুলে নেন বৈভব। অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দেন অসি উইকেটকিপার এবং উইকেটের পিছনে ক্যাচ লুপে নেন কিপার গুরবাজ। দুটি ম্যাচেই কেকেআরের বিরুদ্ধে নিজের খাতা খুলতে পারলেন না এই বিধ্বংসী ক্যাঙ্গারু ওপেনার।
পঞ্চম ওভারে আবার সাফল্য কেকেআরে। এ বার স্টার্কের শিকার রাহুল ত্রিপাঠি। বুকের উচ্চতায় উঠে আসা বলে হুক খেলতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লেগে তা উঠে যায় আকাশে। জরুরী ক্যাচ ধরেন রমনদীপ। ২১ রানে তিন উইকেট হারিয়ে হায়দরাবাদের তখন দিশেহারা অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়।
সেখান থেকে হায়দরাবাদকে ম্যাচে ফেরানোর চেষ্টা করছিলেন এডেন মার্করাম এবং নীতীশ রেড্ডি। বৈভব অরোরার পাওয়ার প্লে-র শেষ ওভারে ১৭ রান ওঠে। পাওয়ার প্লে-র শেষ ওভার বলেই হয়তো ঝুঁকি নিতে চেয়েছিলেন হায়দরাবাদের দুই ব্যাটার।
তারপর সপ্তম ওভারে আবার ধাক্কা। এ বার ওভারের শেষ বলে ‘বার্থডে বয়’ নীতীশকে রেড্ডি-কে ফেরান হর্ষিত। পঞ্চম স্টাম্পে করা দারুণ আউট স্যুইং বল নীতীশ খোঁচা দেন রহমানুল্লা গুরবাজের হাতে।
কোনও জুটিই টিকছিল না হায়দরাবাদের। মার্করাম সঙ্গে যোগ দেন হেনরিখ ক্লাসেন। দুই প্রোটিয়া ব্যাটারের হাত ধরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারল না অরেঞ্জ আর্মি। বেশ কিছুক্ষণ রক্ষণাত্মক খেলার পর পরিস্থিতির চাপে আন্দ্রে রাসেলের দ্বিতীয় বলে সাফল্য মেলে। রাসেলের স্লোয়ার বলে তুলে খেলতে গিয়েছিলেন মার্করাম। লং অনে স্টার্কের হাত যায় একটি সোজা ক্যাচ। রাসেলের হাতে ওই সময়ে বল দিয়ে আরও একবার নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন অধিনায়ক শ্রেয়স আইয়ার।
দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারের মতো ফাইনালে ভাল খেলতে পারলেন না শাহবাজ। ধরে খেলার বদলে আচমকাই ঝুঁকি নিয়ে ফেললেন বাংলার এই ক্রিকেটার। বরুণ চক্রবর্তীর প্রথম ওভারেই তাঁকে সুইপ করতে গিয়ে ধরা দেন সুনীল নারিনের হাতে। ব্যাটিং অর্ডারের ধস সামলাতে ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ হিসাবে এসআরএইচ ম্যানেজমেন্ট নামিয়ে দিয়েছিল আব্দুল সামাদকে। কিন্তু তিনিও কোনও ‘ইমপ্যাক্ট’ রেখে যেতে পারলেন না। অফস্টাম্পের বাইরে করা রাসেলের ধীর গতির বলে খোঁচা দিয়ে তাঁকে ফিরে যেতে হল মাত্র ৪ রানে।
তখনও হায়দরাবাদের আশার প্রদীপের আলোর শেষ ছটাক হেনরিখ ক্লাসেন ক্রিজে ছিলেন। কিন্তু অপরদিক থেকে সমর্থনের অভাবে ক্লাসেন আগের ম্যাচগুলির মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারছিলেন না। পরিস্থিতির চাপে রক্ষণাত্মক খেলতে হচ্ছিল তাঁকে। দলের ইনিংসকে শেষ অবধি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ২০ ওভার পুরো খেলে একটি সম্মানজনক স্কোরে টিমকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু বিধি বাম! হর্ষিতের বলে কভারের উপর দিয়ে খেলতে গিয়ে ব্যাটের ভেতরের কানায় লেগে প্লেয়ড-অন হয়ে বোল্ট হতে হল তাঁকে।
তারপর ফাইনালের দিনের আরেক ‘বার্থডে বয়’ সুনীল নারিনের বলে কামিন্সের একটি লোপ্পা ক্যাচ ছাড়েন স্টার্ক। তার ফলে কামিন্স বেশ কিছুটা রান যোগ করলেন দলের খাতায়। ২৪ রান বানিয়ে হলেন আজকের দিনে হায়দরাবাদের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও।
এরপর সুনীল নারিনের বলে স্যুইপ মারতে গিয়ে বল উইকেটেও লাগলেও বেল পড়েনি কিন্তু সেই বলেই ডিআরএস নিয়ে এলবিডব্লু আউট পাওয়া যায় জয়দেব উনাদকটকে। এর মাধ্যমে ১৬ ম্যাচের প্রত্যেক ম্যাচে উইকেট শিকারের ধারা বজায় রাখলেন কলকাতার ‘নারায়ণ’ সুনীল নারিন।
১৯তম ওভারে রাসেলের গুড লেংথ বলকে তুলে মারতে গিয়ে আউট হন অধিনায়ক কামিন্স। ক্যাচ আসে লং অনে আর ফিল্ডার ছিলেন মিচেল স্টার্ক। কিন্তু এবারে আর কোনও ভুল করেন নি তিনি। এভাবেই মাত্র ১১৩ রানে এবং ১৮.৩ ওভারে ইনিংস শেষ হয় সানরাইজার্স হায়দরাবাদের।
তার মানে কলকাতা নাইট রাইডার্সকে তৃতীয়বারের জন্য আইপিএলে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা ছিনিয়ে নিতে টার্গেট চেস করতে হত ১২০ বলে মাত্র ১১৪ ওভার। অর্থাৎ ওভার প্রতি ৬ রানেরও ক
প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই ভুবনেশ্বর কুমারকে চার মেরে চেস শুরু গুরবাজ। পরের ওভারের প্রথম বলেই কামিন্সকে লম্বা ছয় হাঁকান নারিন। কিন্তু দ্বিতীয় বলেই লেগ স্টাম্পের বাইরের বল ফ্লিক করতে গিয়ে শাহবাজের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন কেকেআর ওপেনার।
দ্বিতীয় ওভারে উইকেট পড়ার চাপ সামলে নেন ভেঙ্কটেশ। ভুবনেশ্বরকে পরের ওভারই একটি চার এবং দুটি ছয় মারেন কেকেআরের এই ইন-ফর্ম ব্যাটসম্যান। এর পর ম্যাচে আর কোথাও ছিলেন না হায়দরাবাদের বোলাররা। কেকেআর ব্যাটারদের তাঁরা টলাতে পারলেন না। গুরবাজ আর আইয়ারের পার্টনারশীপের সময়ে হায়দরাবাদের ক্রিকেটারদের দেখে মনে হচ্ছিল, ম্যাচটা তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছেন তাঁরা।
সেই অপেক্ষা বেশি ক্ষণ করতে হল না। গুরবাজ আউট হওয়া সত্ত্বেও ২০ ওভারের খেলায় ১০.৩ ওভারেই প্রয়োজনীয় রান তুলে ১৭তম আইপিএল সিজনে নিজেদের চতুর্থ ফাইনালে তৃতীয়বারের জন্য আইপিএল ট্রফি জিতে নিল কলকাতা নাইট রাইডার্স আর এবারে তো একপেশেভাবেই।
ম্যাচ জয়ের পরেই ক্যামেরা ফেল কেকেআর মালিক শাহরুখ খানের ওপর । অসুস্থতার কারণে ম্যাচের গোটাসময় জুড়ে তাঁর মুখে ছিল মাস্ক। কেকেআর জেতার পর শাহরুখ খুললেন সেই মাস্ক। সঙ্গে ছিলেন ছিলেন স্ত্রী গৌরি খান ও তিন সন্তান। জয়ের মুহূর্তের পর সবাই হলেন নাচে মত্ত। শুরু থেকে কেকেআর ডাগ-আউটের খুশির পরিবেশ প্রতিযোগিতার শেষেও যথাযথভাবে বজায় থাকল।
রইল ফাইনাল ম্যাচের স্কোরকার্ড:
•SRH: ১১৩ (১৮.৩) •KKR : ১১৪/২ (১০.৩)
কেকেআর ৮ উইকেটে জয়ী (৫৭ বল বাকি থাকতে)
Leave a Reply