দীপঙ্কর গুহ
কখনও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে খোঁজা খুঁজি আর কখনও কাতারে যাওয়া পরিচিতদের থেকে হাল হকিকত বুঝে নেওয়া, এসব চলছেই। আর তার থেকে আজকের এই প্রতিবেদন। রোনাল্ডো প্রেমীদের জন্য স্বস্তির খবর তেমন তো মিললো না। সামনেই ( শনিবার) পর্তুগালের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ। প্রতিপক্ষ এই প্রথমবার শেষ আটে ওঠা আফিকার দেশ মরক্কো। এই ম্যাচেও শুরু থেকে থাকবেন না সি আর সেভেন! এই খোঁজা খুঁজি সময় দেখলাম, পর্তুগাল শেষবার মরক্কোকে সামলেছিল ২০১৮ সালে। রোনাল্ডোর করা একমাত্র গোলে জিতেছিল পর্তুগাল।
আশঙ্কা তেমনই। টিভিতে আর পরে সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ কিছু ছবি-ভিডিও দেখার পর মনে হচ্ছে, পর্তুগাল কোচ আর অধিনায়ক এক সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে পারছেন না। কিন্তু খটকা একটাই, এই পর্যায়ের টুর্নামেন্ট -নেতাকে না জানিয়ে চূড়ান্ত দল সাজিয়ে ফেলা হয়? মনে হয় , এটা সম্ভব নয়। তাহলে রোনাল্ডো কখন থেকে জানেন, তিনি প্রথম একাদশে নেই?
রোনাল্ডোর বান্ধবী জর্জিনা ইনস্টাগ্রামে এমন একটা পোস্ট করে বসেছেন তাতে জল্পনার জট আরও বেড়ে গেছে। রোনাল্ডো দলের নেতা, অথচ প্রথম একাদশে নেই। তাঁর চোটের কোনও খবর নেই। এখানে জাতীয় দলে কোচ – নেতার মনোমালিন্যের খবর নেই। তাহলে!
দল জিতেছে ৬-১ গোলে প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে।
কোচ ফার্নান্দো সান্তোস যে দল খেলিয়ে ছিলেন, তাতে এক ভবিষ্যতের তারকার জন্ম হল। গনসালো রামোস হ্যাটট্রিক করে নিলেন। সেই দিনের নায়ক। কার বদলে নেমেছিলেন? বিশ্বের গোল মেশিন ‘রোনাল্ডো’র বদলে। এত গোল হয়ে যাওয়ায় কোচ সান্তোস সমালোচনার গনগনে আঁচে পুড়লেন না। তাও যা যা মাঠে আর মাঠের বাইরে হচ্ছে – বোঝা যাচ্ছে , ঝড় বয়ে চলেছে। এরপর যদি একই রাস্তায় হাঁটেন কোচ? আবার যদি পরের ম্যাচে একই ঘটনা ঘটে? শুরু থেকে রোনাল্ডোকে মাঠের বাইরে বসতে দেখা যায়!
কোথাও কি রোনাল্ডো আর পর্তুগাল – একই বৃন্তে দুটি ফুল ভাবনাতে ধাক্কা খাচ্ছে? কেউ মন খুলে কিছুই বলছেন না। রোনাল্ডো সুইজারল্যান্ড ম্যাচ জেতার পর আর দলের অনুশীলনে যোগ দিলেন না। মরক্কো ম্যাচের ঠিক আগের দিন নিশ্চয়ই দেবেন। পেশাদার তিনি। এখন হয়তো সময় তাঁর সঙ্গে হাত ধরে হাঁটছে না। বারবার অন্য কিছু ঘটে চলেছে।
কোচ সান্তোস যাঁকে নামিয়ে দিয়েছিলেন তারকা সি আর সেভেনের জায়গায়, সেই গনসালো রামোস হ্যাটট্রিক করে দিয়েছেন। তাঁকে আর বসানোর কথা ভাবাই যায় না। যদিও সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটিতে ৭৪ মিনিটের পর এই রামোসকেই বসিয়ে কোচ সান্তোস সেই রোনাল্ডোকে মাঠে এনেছিলেন। আবার ক্যাপ্টেনের আর্ম ব্যান্ড পড়ে মাঠে নেমেছিলেন।
কিন্তু খুশি মনে কি নেমেছিলেন রোনাল্ডো? দলের গোল পাওয়ার আনন্দে রিজার্ভ বেঞ্চ ছেড়ে নেচে উঠেছিলেন। সেই তিনি , খেলা শেষে সতীর্থদের সঙ্গে মাঠের মাঝে আনন্দে মাতেননি। একা একা আগেই মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যান। আর সেই ফিরে যাওয়ার রাস্তায় কোচ যখন মহাতারকার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছিলেন , রোনাল্ডো অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে দায়সারাভাবে হাত মিলিয়ে চলে যান।
এই ছবিগুলো, অন্য কিছু বার্তা দিয়ে যায়।
রামোসের বয়স মাত্র ২১ বছর। তাঁরও স্বপ্নের নায়ক, রোনাল্ডো। ম্যাচের ১৭, ৬১, ৬৭ মিনিটে তিন গোল দিয়ে হ্যাটট্রিক করে ম্যাচের নায়ক হয়ে কয়েক মিনিট পরে ‘হিরো’ রোনাল্ডোকে জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বাকি গোল গুলো হয়েছিল পেপে ( ৩৩ মিনিটে), রাফায়েল গুররেইরো (৫৫ মিনিটে) আর রাপাফেল লেও (৯২ মিনিটে) দের দাপটে । আর বিপক্ষ একটি গোল করছিল (৫৮ মিনিটে)।
মাঠে নামছেন তিনি – রোনাল্ডো। সেটাও হয়েছিল বোধহয় চাপে পড়ে। গোটা স্টেডিয়াম প্রায় দশ মিনিট ধরে একস্বরে বলে যাচ্ছিল: রো-না-ল-ডো, রো-না-ল-ডো । মাঠে নেমে তিনি বেশি বল পাননি, কিছু করার সুযোগও তাই জোটেনি।
সকলে জানতে চায়, আবার কি রোনাল্ডো কোচের কোপে পড়েছেন?
কোচ সান্তোস বলে দিয়েছেন : ‘আমার সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক। তা বরাবরের মত এখনও অটুট। সেই ১৯ বছর বয়স থেকে ওকে দেখছি। রোনাল্ডো আর আমি এই কোচ – ক্যাপ্টেন বা কোচ – ফুটবলার সম্পর্কে আটকে নেই। আমি সবসময় মনে করি আমাদের দলের সে এক মস্ত বড় স্তম্ভ।’ এই কথাগুলো কখন বলেছেন সান্তোস? যখন তাঁকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করে ছিলেন, কোয়ার্টার ফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে শুরু থেকে মাঠে রোনাল্ডোকে দেখা যাবে কি? নাকি আগের ম্যাচের মত তাঁকে পরে মাঠে আনা হবে?
টিমের স্ট্র্যাটেজি!
কোচ সান্তোস হয়তো বুঝে গেছেন সি আর সেভেনকে মাঠের বাইরে বসিয়ে রাখার চাপটা কী ভয়ঙ্কর। তাই বলছেন, ‘কোয়ার্টার ফাইনালে নিশ্চিতভাবে রোনাল্ডো আমাদের স্ট্র্যাটেজির মধ্যেই আছে। রিজার্ভ বেঞ্চে বসা সকলে দলকে জেতাতে মাঠে নামতে প্রস্তুত। শুরুতে দলে না থাকলেও পরে মাঠে নামছে। রোনাল্ডো বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। চূড়ান্ত পেশাদার। দলের অধিনায়ক। এই মুহুর্তে সকলে দলের কথাই ভাবছি। সকলকে একজোট হয়ে তাই ভেবে যেতে হবে। দারুণ খেলে দল উঠেছে শেষ আটে । এই ছন্দ ধরে রাখতে হবে।’
‘ঐতিহাসিক এক জয়’
এমনটাই তো নিজের সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখেছেন রোনাল্ডো। পজিটিভ মানসিকতা নিয়ে চলছেন। ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন,’ পর্তুগালের জন্য এক স্মরণীয় দিন ( শেষ ১৬ তে জয়)। বিশ্বকাপের মত আসরে এই পর্যায়ে এই স্কোর দারুন ব্যাপার। দলের দক্ষ ফুটবলারদের সেরাটা মাঠে উজাড় করে দেওয়া, আগামীর নায়কদের সেরা হয়ে ওঠা – সব দারুণ পাওনা। দল সাজানো ধন্যবাদ যোগ্য কাজ। স্বপ্ন এখনও বেঁচে আছে। শেষ পর্যন্ত থাকবে। এটাই পর্তুগালের শক্তি।’
আর পর্তুগালের নয়া নায়ক রামোস কী বলছেন? – ‘ক্রিস্টিয়ানো আমদের নেতা। সারাক্ষণ আমাদের সবভাবে সাহায্য করেন। দারুন এক মানুষ। আমাদের আইডল।’
রোনাল্ডোর প্রাক্তন ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড সতীর্থ ব্রুনো ফার্নান্দেজ কিন্তু তারকা ফুটবলারের মনের যন্ত্রণাটা বুঝতে পেরেছেন। বলেছেন, ‘রিজার্ভ বেঞ্চে কেউ বসে থাকতে চায় না। রোনাল্ডো তো নয়ই। আমাকেও যদি ম্যানেজার বেঞ্চে বসাতো আমারও মেজাজ বিগড়ে যেত।
ফ্যানরা ফুঁসছে:
সত্যি ফুঁসছে ফ্যানরা। এমন একজনের বক্তব্য: ‘আমি ৩০০ ইউরো দিয়ে ( ভারতীয় মুদ্রায় ২৬ হাজার টাকা) এই প্রি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের টিকিট কিনেছিলাম। রোনাল্ডো – তাঁর শেষ বিশ্বকাপ খেলতে নেমেছেন। তাঁর জন্য আমরা মাঠে ভিড় করছি। তিনি এখনও পর্যন্ত যা যা করেছেন, তারজন্য সম্মানটা তাঁর প্রাপ্য। ফ্যানদের খুশি রাখতে নিজেকে উজাড় করে ফুটবলটা খেলেন। তিনি না খেললে, আমরা কিছুই তো পাব না।’
মাত্র ১৫ মিনিটের সি আর সেভেনে কারই বা মন ভরে! সান্তোসরা বোঝেন সেটা?
ছবি: সৌ টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ।
Leave a Reply