স্বাতী চ্যাটার্জি– ধরা যাক আপনাকে এমন একটা বাড়িতে থাকতে বলা হল, যে বাড়িতে আলো বলতে প্রকাণ্ড মোমবাতিদানে সাজানো আলো। প্রকাণ্ড হল ঘর। চারপাশে সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো পাথরের মূর্তি। নির্জন, নিস্তব্ধ। সন্ধে যত নামে, ঝিঁঝি পোকার ডাক, ব্যাঙের ডাকে গম গম করতে থাকে এলাকা।
রাত যত গভীর হয়, ছাঁদের ক্ষীণ আলো, অট্টালিকার কাচের জানালা ফুঁড়ে ভেরতে প্রবেশ করে। মাঝে মধ্যে একটা ঠান্ডা জোলো হাওয়া বয়ে যায়। ছাদ থেকে ঝুলতে থাকে, একটা বিশাল বেলজিয়াম কাচের ঝাড়লন্ঠন হাওয়ায় দুলতে থাকে।
গভীর রাত, চারপাশ নিঝুম। আচমকা আপনার ঘুম ভাঙল, তখন ঠিক কেমন মনে হবে? হ্যাঁ মনে হবে, যেন কোনও স্বপ্ন নগরীতে পৌঁছে গিয়েছেন। প্রকৃতিক পারিপার্শ্বিক আহবের মধ্যেই যেন কেউ বা কারা ফিসফিস করে কথা বলছে। একেকবার মনে হবে আপনার সঙ্গেই যেন তারা কথা বলতে চাইছে। একটা সময়ে আপনার দৃঢ় বিশ্বাস হবে, হ্যাঁ, হল ঘরের পাশে থরে থরে সাজানো নিষ্প্রাণ মূর্তিগুলো আপনার সঙ্গে পরিচয় করতে চাইছে। জানতে চাইছে, এই স্বপ্ননগরীতে আপনার আগমন কেন?
এতোক্ষণ লেখাটা পড়ে কি বোর হলেন? ভাবছেন কোনও ভৌতিক গল্পের ভূমিকা তৈরি করছি? তাহলে একটাই উত্তর, না এমন কোনও অভিপ্রায় আমার নেই। বরং কলকাতার মধ্যেই এমন এক অট্টালিকা রয়েছে, যেখানে গেলে এমন কথা মনে হতে বাধ্য।
মার্বেল প্যালেস নামটা নিশ্চয়ই শুনেছেন। কেউ কেউ হয়তো দেখেওছেন। আর যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা আমার অনুভূতির শব্দরূপ মেলাতে পারছেন। মার্বেল প্যালেস যে জায়গায় অবস্থিত সেই জায়গার পুরনো নাম চোরবাগান।
একটা সময়ে এই রাস্তা ধরেই সোজা গঙ্গার ঘাটে যেতেন পুণ্যার্থীরা। আর বণিকরা বাণিজ্যে। সেই সময় এই এলাকা ছিল ঝোপঝাড়ে ভর্তি। আর এখানেই লুকিয়ে থাকতো কুখ্যাত লেঠেল চোর ডাকাতেরা। সুযোগ পেলেই যাত্রীদের লিঠ করা হত। আর বাধা দিতে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু।
চোরবাগান নাম হওয়ার পিছনে এক কলঙ্কময় ইতিহাস রয়েছে। এই মার্বেল প্যালেস ১৮৩৫ সালে তৈরি করেন রাজেন্দ্র মল্লিক। ভিত খোঁড়ার সময় এই জমি থেকে ও আশে পাশের অঞ্চল থেকে বহু মানুষের কঙ্কাল ও মাথার খুলি উদ্ধার হয়। বাগান সহ ২৫ বিঘে জায়গার উপর এই বাড়ি যখন তৈরি হয়, তার পর থেকে এই এলাকার রূপ বদলাতে থাকে। বাড়িটি যেমন পাশ্চাত্য স্থাপত্যরীতিতে তৈরি তেমনই এখানকার শিল্পসংগ্রহ দেখার মতো।
রাজেন্দ্র মল্লিকের জন্ম ১৮১৯ সালে ২৪ জুন। পাথুরিয়াঘাটার নীলমণি মল্লিক তাঁকে দত্তক নেন। রাজেন্দ্র বয়স যখন ৩ তখনই নীলমণি মারা যান। নীলমণির এস্টেট নিয়ে শুরু হয় মামলা। সেই সময় বাংলার সুপ্রিম কোর্ট, নাবালক রাজেন্দ্রর অছি বা অ্যাটর্নি নিযুক্ত করে স্যার জেমস উইলার হগকে। রাজেন্দ্র সাবালক হলে, এস্টেটের দায়িত্ব নেন। তাঁর ছিল সোনার ব্যাবসা (অলঙ্কার নয়) সোনা তিনি কেনাবেচা করতেন।
হৃদয়বান, মার্জিত রুচির জন্য ব্রিটিশদের কাছে প্রথমে রায়বাহাদুর পরে রাজাবাহাদুর উপাধী পান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মার্বেল প্যালেসের প্রাথমিক প্ল্যান বানিয়েছিলেন হগ সাহেব। তাতে কিছুটা বদল আনেন রাজেন্দ্র। ইতালি, ইংল্যান্ড, জার্মানি ও চিন থেকে আনা হয়েছিল বহু স্থাপত্যশিল্পী ও কারিগরকে।
ইতালির স্থপতিরা করেছিলেন মার্বেলের ফ্লোরের কাজ। ফরাসিরা করেছিলেন, লে আউট, ভেসটিউবল, পোর্টিকো ও বাড়ির সামনের অংশ। ইংরেজ কারিগরেরা করেন আসবাবপত্র ও অন্যান্য ফিটিংস।
গ্রিক প্যাটার্নের বাড়ির স্থাপত্যে মিশে রয়েছে রোমান কারুকাজ। বাড়ির অন্দরে পশ্চিম অংশের বাইরে সারিবদ্ধ লোরিক থামের ওপর রাখা আছে করিডর ও ভেসটিউবল। উত্তরে করিন্থিয়ান থামের সারি। দুপাশে ফরাসি পোর্টিকো। ধালাই লোহার লতা পাতা-ফুল, ফলের নক্সা আনা হয়েছিল ফ্রান্স থেকে।
হলবারান্দায় ধোকার মুখেই রয়েছে স্নাইডান ভেনাস। নারীদেহের সৌন্দর্যের অন্তর্নিহিত শিল্পরূপটি এত সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে, যা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। অশ্লীলতার দায়ে সম্পূর্ণ এই নগ্ন মূর্তিকে এক সময় স্নাইডিয়ান দ্বীপে পাঠানো হয়। মাইকেল এঞ্জেলোর পর বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিল ভেনাসের মূর্তি, তারও কিছু রূপ এখানে রয়েছে।
বিদেশী পেন্টিং, বিদেশ থেকে আনা নানা পাথরের মূর্তি পোর্সিলিনের ফুলদানি, বাতিদান আরও কত কী! পুরো অট্টালিকাই একটা আর্ট গ্যালারি। বর্তমানে বাড়ির মালিক হীরেন মল্লিক। তিনিও যথেষ্ট শিল্পরসিক মানুষ।
আরও পড়ুন– লাদাখের নিষিদ্ধ গ্রাম, বিদেশ থেকে মহিলারা আসতেন গর্ভবতী হতে!
দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগেই, কলকাতার জোড়াসাঁকো, পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে বেশ কিছু বাঙালি বণিকের বাস গজিয়ে ওঠে। যেমন ঠাকুরবাড়ি, মল্লিকবাড়ি, মিত্র বাড়ি, ঘোষবাড়ি ইত্যাদি। এদের মধ্যে হাতে গোনা দুজনের প্রাইভেট চিড়িয়াখানা ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম এই মল্লিকবাড়ি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, বণ্যপ্রাণ আইন লাগু হওয়ায়। প্রাইভেট চিড়িয়াখানার জৌলুস হারিয়েছে। যদিও, কিছু বিরল প্রজাতির পাখি এখনও এখানে রাখা আছে।
আরও পড়ুন- রহস্যময় পুতুল দ্বীপ কেন ভয়ঙ্কর, কী তার কাহিনি?
রাজেন্দ্র মল্লিক ছিলেন জগন্নাথ ভক্ত। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে একটি কুলদেবতা হিসেবে জগন্নাথদেব বিরাজ করছেন। এই অট্টালিকা দর্শনে কোনও প্রবেশ মূল্য নেই। তবে সরাসরি এই অট্টালিকায় পৌঁছলে প্রবেশ পথে বাধা পড়তে পারে। এখানে যাওয়ার আগে টিকিট সংগ্রহ করুন।
টিকিট পাবেন, হোচি মিন সরণিতে ইনক্রেডিবেল ইন্ডিয়ার অফিস থেকে। আগাম টিকিও সংগ্রহ করে রাখতে পারেন। সেখান থেকে টিকিট সংগ্রহ করে, মেট্রো ধরে নামুন মহত্মাগান্ধী রোডে। কিছুটা সোজা এগিয়ে পড়বে চোরবাগান। বাঁদিকের পথ ধরে, সোজা কিছু হাঁটলেই বাঁ দিকে নজরে পড়বে মার্বেল প্যালেস।
আরও পড়ুন- কলকাতায় পারসিদের অন্ত্যেষ্টি যে ভাবে হত, জানলে চমকে যাবেন
তাহলে আর দেরি কেন? একদিন পুরো পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন নগরের অন্দরে লুকিয়ে থাকা এক আজব যাদুঘর ঘুরে দেখতে।
Leave a Reply