স্বাতী চ্যাটার্জি– এক দ্বীপ, সেখানে কোনও আলো নেই। একটা দ্বীপ, সেখানে কোনও মানুষ থাকে না। একটা দ্বীপ, সেখানে পাখিরা আসে, কিন্তু বাসা করে না। এমনই একটা দ্বীপ, যেখানকার বাসিন্দারা শুধুমাত্র পুতুল। থরে থরে, গাছের ডালে ঝুলে রয়েছে, রহস্যময় পুতুল।
দ্বীপের মধ্যে প্রবেশ করলেই, এক অদ্ভুত অনুভূতি জাঁকিয়ে বসে। ঘাড় বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। আচমকা পুরো পরিবেশটাই কেমন যেন শীতল হয়ে ওঠে। গাছের পাতা ঝরে পড়লেও, তার শব্দ শোনা যায় না। আশ্চর্য রকমের শান্ত, স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ।
আজকের প্রতিবেদন এমন এক রহস্যময় দ্বীপকে ঘিরে, যা বহুদিন পর্যন্ত কারও নজরে আসেনি। কিন্তু সেই দ্বীপে এমন কিছু ঘটেছিল, যা একটা সময়ে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ইসলা দে লাস মুয়েকাস। এটি একটি স্প্যানিশ ভাষা, যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় পুতুলদের দ্বীপ। মেক্সিকো শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই দ্বীপ। এখানে যাওয়ার একমাত্র পথ, ফেরি করে সোচিমিলকো ক্যানালের জলপথ। এমবারকোডারো ক্যুমাঞ্চো থেকে ধরতে হয় ফেরি। প্রায় দেড় ঘণ্টার খাঁড়ির জলপথ পেরিয়ে দেখা মেলে ওই দ্বীপের।
দ্বীপের পারিপার্শ্বিক দৃশ্য যতটা ভয়ঙ্কর, কাহিনি ঠিক ততটাই বিয়োগান্ত। কাহিনির শুরু এক চরিত্রকে ঘিরে। নাম, ডন জুলিয়ান সেন্তানা বারেরা। জন্ম ১৯২১ সালে। মেক্সিকোর সোচিমিলকো ক্যানাল লাগোয়া একটি এলাকাতেই স্ত্রী সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। পেশায় ছিলেন কৃষক। নিজের উৎপাদিত শাস সব্জি বিক্রি করতে যেতেন আশে পাশের অঞ্চলে।
যেখানে তিনি সব্জি বিক্রি করতে যেতেন, সেখানকার একটি চার্চের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ান। ফলে তাঁকে ওই অঞ্চল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁর শাক সব্দি বিক্রিবাটাও বন্ধ হয়ে যায়। এরপরেই শুরু হয় ঘরের মধ্যে সমস্যা। অগত্যা নিজের গন্ডোলা নিয়ে গৃহত্যাগ করেন। ক্যানাল ধরে যখন তিনি যাচ্ছিলেন, তখনই একটি দ্বীপের ভেতর ঘন জঙ্গল থেকে কীসের একটা চিৎকার শুনতে পান।
গন্ডোলাটি দ্বীপের কাছে ভিড়িয়ে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করে দেখেন, একটি বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করছে। তিনি মেয়েটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, সে কান্নাকাটি করছে কেন? পাশাপাশি আরও প্রশ্ন করেন, এই জঙ্গলে সে একা কী করে এলো, তার বাবা মা কোথায়?
মেয়েটি কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বলে, তার পুতুলটি ক্যানেলের জলে পড়ে রয়েছে। ডন জুলিয়ান, মেয়েটির আবদার মেনে, পুতুলটিকে তুলতে যায়। কিছুক্ষণের চেষ্টা পুতুলটিকে তুলেও আনে। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটিকে আর দেখতে পায় না। ডন জঙ্গলের মধ্যে মেয়েটিকে খুঁজতে শুরু করে।
বেশ ক্ষাণিক্ষণ খোঁজার পর, এক ভয়াবহ ছবি তার সামনে ধরা পড়ে। ক্যানেলের একটি পাড়ে মুখ গুঁজে পড়ে রয়েছে বাচ্চা মেয়েটি। ডন তার কাছে গিয়ে দেখে, মেয়েটি মারা গিয়েছে। মেয়েটির দেহ তুলে, পাশেই একটি জায়গায় কবর দিয়ে দেন তিনি। আর পুতুলটিকেও তার পাশে শোয়ানো হয়।
তার পরের দিন আবার এক বাচ্চার চিৎকারে, ডন দ্বীপের মধ্যে যায়, কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। পরে মেয়েটির কবরস্থালে গিয়ে দেখে। পাশে পুতুলটি নেই, সেটি টাঙানো রয়েছে পাশের একটি গাছের ডালে। এরপর প্রায় দু তিনদিন পর পর, দ্বীপের মধ্যে প্রবেশ করে নতুন একটি করে পুতুল পান তিনি। সেগুলিকে একের পর এক ডালে টাঙাতে থাকেন।
আরও পড়ুন- আঁধারে থাকা অন্য এক তাজমহলের কাহিনি
ডন অনুভব করেন, রোজ নিত্যনতুন পুতুল পাওয়া যাচ্ছে, এখানে নিশ্চয়ই বাচ্চা মেয়েটির আত্মা রয়েছে। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন। এই দ্বীপেই থাকবেন তিনি। তারপর থেকে ডন ওই দ্বীপেই থাকতেন এবং রোজ একটি করে পুতুল খুঁজে পেতেন আর তা টাঙিয়ে দিতেন জঙ্গলের নানা গাছের ডালে। এক সময়ে সমস্ত দ্বীপ জুড়ে পুতুলে ভর্তি হয়ে গেল।
একবার এক পর্যটক দ্বীপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গাছের ডালে ঝুলতে থাকা পুতুল দেখে কৌতুহলী হয়ে পড়ে। প্রবেশ করে জঙ্গলে। দ্বীপের চিত্র দেখে অবাক হয়ে যায়। পরিচয় হয় ডনের সঙ্গে। পর্যটক শহরে ফিরে সাংবাদিকদের বিষয়টি জানায়, তারপর আর এই দ্বীপের খবর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। দেশ বিদেশের নানা প্রান্তের পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হয়ে ওঠে ইসলা দে লাস মুয়েকাস।
আরও পড়ুন- গুপ্তধনের খোঁজে ইন্দিরা গান্ধী কোথায় গুপ্ত অভিযান চালিয়েছিল?
রাতারাতি দ্বীপের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। পর্যটকেরাও নিজে থেকে অনুদান দিতে শুরু করেন ডনকে। বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে। তাদের সুপারিশে ১৯৮৭ সালে এই দ্বীপকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের তকমা দেওয়া হয়।
২০০১ সালে ডনের বিয়োগান্ত মৃত্যু হয়। তাঁর এক পরিচিতের দাবি, ডন যেখান থেকে বাচ্চা মেয়েটির দেহ উদ্ধার করেছিল, ঠিক সেখানেই মিলেছিল, ডনের দেহ।
আরও পড়ুন- আজব কাহিনি, তাসের খেলায়
কিংস অফ হার্টসের গোঁফচুরি হল কীভাবে?
স্থানীয়দের দাবি, এই দ্বীপে পর্যটকেরা আসতে পারেন, কিন্তু রাতে থাকা মানা। গাছের ডালে ঝুলতে থাকা, কোনও পুতুলকে ছোঁয়া চলবে না। এখানে যা জিনিস, যেখানে রয়েছে, তা সেখানেই থাকতে দিতে হবে। নয়তো, কোনও অঘটন ঘটতে পারে। স্থানীয়দের আরও দাবি, গভীর রাতে এই দ্বীপে অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়, কেউ বা কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। খেলা করছে। একটা সময় এই দ্বীপে থাকতেন ডন, কিন্তু এখন সন্ধের পর ওখানে কেউ থাকেন না।
Leave a Reply