আজ যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার বিরোধী দলনেত্রী পদে থাকতেন আর বামফ্রন্ট বা বিজেপি কোনও নেতা এই সময় কেন্দ্রীয় এজেন্সির হাতে গ্রেফতার হতেন তাহলে রাস্তায় নেমে আন্দোলন গড়ে তুলে বাংলাকে কার্যত স্তব্ধ করে দিতেন মমতা। জনমত যেত তাঁর পক্ষে। বিক্ষোভকে কিভাবে আন্দোলনের চেহারা দিতে হয় সেটা মমতা ভালই বোঝেন।
সোমনাথ পাঁজা : রাজ্যজুড়ে এখন ইডি, সিবিআই তৎপরতা তুঙ্গে। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডি গ্রেফতার হয়েছেন খোদ রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় কোটি কোটি টাকা। অর্পিতাও এখন শ্রীঘরে। আবার গরু পাচার কাণ্ডে গ্রেফতার হলেন অনুব্রত মণ্ডল। তা দেখে বাম–বিজেপির নেতারা বাংলাজুড়ে বেশ লম্ফঝম্ফ করে বেড়ালেন। জেরে জেলায় জেলায় সেই বাম আর বিজেপি গুড় বাতাসা আর নকুলদানা বিলি করলো। কোথাও কোথা গরুসেবাও করা হয়েছে।
বিজেপি এখন প্রধান বিরোধী দল। কিন্তু প্রশ্ন হল এই এত কিছু করে আখেরে লাভ কী হচ্ছে? বাংলার মানুষ কী বাম আর বিজেপিকে আগামী নির্বাচনে ভোট দেবেন? বাংলায় কী আবারও পরিবর্তন ঘটবে? বিজেপি বা বামেদের লোকসভা কেন্দ্রে, জেলা পরিষদে, পঞ্চায়েত সমিতিতে, গ্রাম পঞ্চায়েতে, পুরসভা বা পুরনিগমে আসন বাড়বে? সন্দেহ প্রকাশ করছেন খোদ সঙ্ঘ কর্তারা। মানে আরএসএস নেতারা। ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁরা মেনে নিচ্ছেন, বাংলায় মমতার বিকল্প মুখ যতক্ষন না উঠে আসবে ততক্ষন নতুন করে পরিবর্তন কার্যত অসম্ভব। তা সে মোদি নিজেও এলেও যে পরিবর্তন ঘটবে না সেটা একুশের নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে।
উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বড় জয় পায় বিজেপি। বাংলার বুকে ১৮টি লোকসভা কেন্দ্রে জিতেছিল। তার জেরেই বঙ্গ বিজেপির নেতারা উদ্বাহু হয়ে হাঁক পাড়তে শুরু করেছিলেন যে, ‘উনিশে হাফ একুশে সাফ’। কার্যত সেই হাঁকডাকে ভরসা রেখেছিলেন বিজেপির শীর্ষ নেতারাও। আর তাই দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ ডজন ডজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ভিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় বাহিনী, কেন্দ্রীয় এজেন্সি সব কিছু নিয়ে গেরুয়া শিবির রে রে করে মাঠে নেমে পড়েছিল বাংলা দখল করতে। শ্লোগান উঠেছিল, ‘আবকে বার ২০০ পার’। কিন্তু ২০০ তো বহু দূর, তার অর্ধেক ১০০ আসনও জুটল না বিজেপির ভাগ্যে। মাত্র ৭৭ আসন পেয়েই ক্ষান্ত হতে হয় বিজেপিকে। এখন পার্থ-কেষ্ট কাণ্ডে তৃণমূল কংগ্রেস বেশ বিপাকে পরেছে এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই। এই ঘটনায় বঙ্গ বিজেপি শিবিরে একটু চনমনে ভাব এসেছে ঠিকই কিন্তু তাতে বিজেপির কতটা লাভ হবে প্রশ্ন ঘুরছে খোদ সঙ্ঘে। প্রশ্ন ঘুরছে বঙ্গ বিজেপির অন্দরেও। কারণ একটাই, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্ঘের কর্তারা মানছেন যতক্ষন না বাংলায় মমতার বিকল্প মুখ তুলে ধরা না হবে ততদিন রাজনৈতিক ভাবে বিজেপি সাফল্য পাবে না বাংলার বুকে।
উনিশের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বাংলার মাটিতে যে সাফল্যের মুখ দেখেছিল তা বিধানসভায় এসে থমকে যায়। এখন বাংলায় জেলায় জেলায় বিজেপির সংগঠন ভেঙে পড়েছে। বুথ স্তরে দলের পার্টি অফিস খোলার লোক নেই। কেন ঝান্ডা বওয়ার লোক নেই। দলের অন্দরে আদি বনাম নব্যের চাপা গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব রয়েছে।
মমতা যখন বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন তখনও অনেক নির্বাচনে তৃণমূল হারের মুখ দেখেছে। কিন্তু এত দুরাবস্থা তাঁদেরও কোনওদিন হয়নি। তাহলে বিজেপি এই বিপাকে কেন? সঙ্ঘের নেতাদের দাবি, বাংলায় এখন সব থেকে বড় অভাব যোগ্য বিরোধী দলনেতা বা নেত্রীর। আজ যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার বিরোধী দলনেত্রী পদে থাকতেন আর বামফ্রন্ট বা বিজেপি কোনও নেতা এই সময় কেন্দ্রীয় এজেন্সির হাতে গ্রেফতার হতেন তাহলে রাস্তায় নেমে আন্দোলন গড়ে তুলে বাংলাকে কার্যত স্তব্ধ করে দিতেন মমতা। জনমত যেত তাঁর পক্ষে। বিক্ষোভকে কিভাবে আন্দোলনের চেহারা দিতে হয় সেটা মমতা ভালই বোঝেন। মানুষের পালস বোঝেন এমন নেতাই নেই। বিজেপি বা বামেদের মধ্যে কোনও গ্রহণযোগ্য মুখই নেই যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন। আর তার মূল কারণ মমতার বিকল্প মুখের চূড়ান্ত অভাব। যদি আগামিদিনে আরও ৭-৮জন নেতাও গ্রেফতার হন তাতেও যে পরিস্থিতি খুব একটা বদলাবে এমনটা মনে করছেন না সঙ্ঘ কর্তারা। আগামী দিনে বাংলায় পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে চলেছে। এটাই তৃণমূলের কাছে এসিড টেস্ট। সেখানেই অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।