দীপঙ্কর গুহ: খবরটা পড়ার সময় আতঙ্কের ছবিটা আমার নিজের চোখের সামনে নাচছিল। এই যে ফুটবলাররা কাতার বিশ্বকাপে লড়াই করে গেল, তাঁদের পরিবারের উপর এতো চাপ ছিল! প্রথম ম্যাচে, দেশের মহিলাদের হিজাব বিরোধী আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে ফুটবলাররা মাঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতে গলা মেলেননি। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে তা আর হয়নি। ফুটবলাররা সুর মিলিয়ে ছিলেন। মঙ্গলবার, গ্রুপের শেষ ম্যাচেও থাকছে সেই চাপ। দেশে প্রতিটি সদস্যের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়ে আসা হয়েছে, বেচাল কিছু করলেই-পরিবারের আত্মীয়দের জেলে ভরে দেওয়া হবে। আর সেখানে কী অকথ্য অত্যাচার চলে – সে সকলের জানা। ফুটবল দলের সকলে জানতেন।
এমন চাপের হুমকির খবর ফাঁস হয়েছে, কাতার বিশ্বকাপের নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীর সূত্র থেকে। ২১ নভেম্বর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ ছিল ইরানের। সেই ম্যাচে, ইরানের ফুটবলাররা জাতীয় সংগীত বাজার সময় সকলে নীরব ছিল। ছিল এক বিচিত্র প্রতিবাদ। তারপরই শুরু হয় আসল নাটক। ইরানিয়ান রিভলুশনারি গার্ড কর্পস (IRGC) গ্রুপের সদস্যদের কয়েকজনের প্লেয়ারদের সঙ্গে মিটিং ডেকেছিল।
কী কী শুনতে হয়েছিল দলের সকলকে সেদিন? সূত্র থেকে নাকি জানা গিয়েছে, বাহিনীর পক্ষ থেকে কড়া ভাষায় বলে দেওয়া হয়, যদি তারা আবার জাতীয় সংগীত বয়কট করে তাহলে দেশে তাদের পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের অকথ্য অত্যাচার আর মারধর সামলাতে হবে! কিংবা রাজনৈতিক এই ধরনের প্রতিবাদে সামিল হয়ে বিরোধিতা করে তেহরান নির্দেশের – ফল একই হবে। কী মারাত্মক চাপ! তার মধ্যে এত বড় টুর্নামেন্টে কী লড়াকু মেজাজে মাঠে খেলবে! তবুও ওরা অন্য চেহারায় ফিরে ছিল। গত শুক্রবার আরেক ব্রিটিশ দল ওয়ালেসকে ২-০ গোলে হারিয়ে দেয়।
বিদেশি এক আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের প্রতিনিধি বের করে এনেছেন, আরও বিস্ময়কর তথ্য। কাতারে ইরানের নিরাপত্তারক্ষী দলের গতিবিধি যে দল নজর রাখছে, তাদের থেকে জানা গেছে – প্রায় এক ডজন আইআরজিসি ( IRGC) রক্ষী সারাক্ষণ এই দলকে আগলে রেখেছে। কারোর সঙ্গে মিশতে দিচ্ছে না। আর বিদেশিদের সঙ্গে তো মেলামেশার প্রশ্নই নেই।
ইরান দলের কোচ একজন পর্তুগিজ। কার্লোস কিরোজ। তিনি নাকি দলের ফুটবলারদের হয়ে এই নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনায় বসে ছিলেন। ওঁর দলের সাফল্য পেতে ফুটবলারদের মনের উপর চাপ কমানো দরকার এটা বোঝানোর চেষ্টা করেন। ফুটবলার আর তাদের পরিবারের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভয়ের এই প্রকান্ড চাপ সরানোর আবেদন জানান।
একটা রটনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, কার্লোস নাকি এই আলোচনায় বলেছিলেন – ফুটবলাররা ফিফার নিয়ম মেনে বিশ্বকাপের মাঝে প্রতিবাদ জানাতে পারে। সূত্র মারফত নাকি জানা যায়, ইংল্যান্ড ম্যাচের আগে দলের মনোবল চাঙ্গা করতে নানান উপহার আর গাড়ি দেওয়ার কথা ফুটবলারদের শোনানো হয়েছিল। কিন্তু ইংল্যান্ড ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সংগীত বয়কট করায় পুরো ছবিটাই বদলে যায়। এই নিরাপত্তারক্ষীরা ‘মারাত্মক হুমকি’ দিয়েছিল।
আগের ম্যাচে ওয়েলেসের বিপক্ষে আরও অনেক কিছু দেখা গেছে । জানা গেছে, এই নিরাপত্তারক্ষীদের পাঠানো তথ্য পেয়ে শ’খানেক ইরানপ্রেমী দর্শকরা গ্যালারিতে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরা এখনকার শাসকগোষ্ঠীর হয়ে প্রচার চালাচ্ছিল। ফুটবলপ্রেমীদের মাঝে সঠিক কিছু আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। আজ গ্রুপের শেষ ম্যাচে সামনে মার্কিন বাহিনী। এদের আরও ‘অভিনেতা-অভিনেত্রী’ হাজির করার ছক। এবার হাজার খানেক বিশেষ দর্শক !
সত্যি এই সিনেমার চিত্রনাট্য। দেশে রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে ইরানের ফুটবলাররা বিশ্বকাপ খেলছে। ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস প্রধান ভলকের তুর্ক ইতিমধ্যেই বলে রেখেছেন, ‘পুরো মাত্রায় মানবধিকার ক্ষমতা লঙ্ঘন’ করা হয়ে চলেছে।
ছবি: সৌ টুইটার।
Leave a Reply