নিউজ ডেস্ক: কুস্তির আখড়া থেকে রাজনীতির ময়দান, সমানভাবে দাপিয়ে বেড়ানো মানুষটির নাম মুলায়ম সিং যাদব। কুস্তির প্যাঁচই, প্যাঁচে ফেলছিল তাবড় তাবড় রাজনীতিবিদকে। উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে কংগ্রেসের যে একচেটিয়া আধিপত্য ছিল তা ভেঙে দিয়ে যাদব সাম্রাজ্যের আলাদা পরিচয় তৈরি করেছিলেন পালওয়ানজি। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সমাজবাদী পার্টি। অনুগামীদের কাছে তিনি নেতাজি নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৩৯ সালের ২২ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের সাইফাই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন মুলায়ম সিং যাদব। বাবা সুঘর সিংহ যাদব। মা মূর্তি দেবী। পড়াশোনার শুরু গ্রামেই। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি পা রাখেন রাজনীতির ময়দানে। ১৯৫০ সালে তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি রাম মনোহর লোহিয়ার হাত ধরে।
১৯৬২ সালে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় যশবন্তনগরের একটি গ্রামে কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়। সেখানে প্রতিযোগী হিসেবে ছিলেন মুলায়মও। আর সেই প্রতিযোগিতা দেখতে হাজির হয়েছিলেন সংযুক্ত সোশালিস্ট পার্টির টিকিটে প্রার্থী নত্থু সিংহ। কুস্তি শুরু হলে একের পর এক পালোয়ানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন হন মুলায়ম। মুলায়মের কুস্তির প্যাঁচ দেখে যৌবনে কুস্তি লড়া নত্থু মুগ্ধ হন। মুলায়মের মাথায় হাত রাখেন তিনি। গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের পথ চলা সেই শুরু।
১৯৬৭ সালে প্রথমবার বিধায়ক হন মুলায়ম সিং যাদব। এরপর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আটবারের বিধায়ক। ১৯৭৫ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর গ্রেফতার হন মুলায়ম। দীর্ঘ ১৯ মাস জেল হয় তাঁর। জরুরি অবস্থার শেষে ১৯৭৭ সালে প্রথমবার মন্ত্রী হন মুলায়ম। ১৯৮০ সালে লোক দলের সভাপতি হন তিনি। লোকদল ভাঙার পর ক্রান্তিকারি মোর্চা তৈরি করেন রাম মনোহর লোহিয়ার এই অনুগামী। সে সময় একের পর এক রাজনৈতিক ভাঙাগড়ার সাক্ষী থেকেছে উত্তরপ্রদেশ।
১৯৮৯ সালে কেন্দ্রে ভি পি সিংয়ের সরকারের পতনের পর চন্দ্র শেখরের জনতা দলকে সমর্থন জানিয়ে উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি দখল করেন মুলায়ম। তবে ১৯৯১ সালের এপ্রিলে মুলায়ম সিংয়ের সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয় কংগ্রেস। কেন্দ্রে ভেঙে পড়ে চন্দ্রশেখর সরকারও। ওই বছরই ফের বিধানসভা নির্বাচন হয় উত্তরপ্রেদেশে। লখনউয়ের কুর্সিতে প্রথমবারের জন্য ক্ষমতায় আসে বিজেপি।
১৯৯২ সালে সমাজবাদী পার্টি তৈরি করেন মুলায়ম। ওই সময় বিজেপিকে আটকাতে বহুজন সমাজবাদী পার্টির হাত ধরে সপা। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হন মুলায়ম। তখন কংগ্রসে এবং জনতা দল তাঁকে সমর্থন করে।
১৯৯৬ সালে উত্তরপ্রদেশের মৈনপুরী থেকে সাংসদ হন সমাজবাদী পার্টির সুপ্রিমো। কেন্দ্রে ইন্দ্র কুমার গুজরাল মন্ত্রিসভায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হন মুলায়ম। ১৯৯৯ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকারের পতনের পর অবশ্য কংগ্রেসকে সমর্থন করেনি মুলায়মের দল। ওই বছর লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের দুই আসনে ভোটে লড়েন মুলায়ম সিং যাদব।
২০০২ সালে উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী হন মায়াবতী। সেই সরকার থেকে বিজেপি সমর্থন তুলে নিতেই নতুন করে তোলপাড় শুরু হয় লখনউয়ের রাজনীতিতে। ওই বছরই ডিসেম্বরে তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন মুলায়ম সিং যাদব। এরপর উপনির্বাচনে ৯৪ শতাংশ ভোট পেয়ে রেকর্ড মার্জিনে জিতে বিধায়ক হন সমাজবাদী পার্টি সুপ্রিমো। এরপর ফের ২০১২ সালে উত্তরপ্রেদেশের ক্ষমতায় ফেরে সমাজবাদী পার্টি। তবে তখন মুলায়ম নয় মুখ্যমন্ত্রী হন অখিলেশ।
রাজনীতির ময়দানে ছেলে অখিলেশের সঙ্গেও লড়াইতেও পিছু হটেননি মুলায়ম। ২০১৭ সালে সেই প্রথমবার সমাজবাদী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা নিজের ছেলের কাছে সভাপতির পদ হারালেন। বাপ-বেটার সেই অধিকার দখলের লড়াই গড়িয়েছিল দিল্লির নির্বাচন কমিশনের অফিস পর্যন্ত।
ভারতীয় রাজনীতিতে সাত বারের সাংসদ, ন-বারের বিধায়ক এবং তিনবার মুখ্যমন্ত্রী, তিনবার কেন্দ্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, রাজনীতিতে বিরল কেরিয়ার গো-বলয়ের সেই যাদব নেতার মৃত্যুতে শেষ হল এক যুগের।
Leave a Reply