দীপঙ্কর গুহ: যাদের জন্য , যাদের উপস্থিতিতে ২০১০ সালে ভোটের দৌড়ে জিতে কাতার ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজনে দায়িত্ব পেয়েছিল – সেই কর্তারা আজ কোথায়, কি করছেন, কেমন আছেন?
আসুন , খোঁজ নেওয়া যাক।
সেপ ব্লাটার: তখনকার ফিফা প্রেসিডেন্ট। এখন তিনি ফুটবল দুনিয়ায় নিষিদ্ধ।
জুলিও গ্রণডোনা: তখন ছিলেন ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য। ২o১৪ সালে এই আর্জেন্টাইন কর্তা মারা যান। আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত গোলমালে অভিযুক্ত ছিলেন।
মিচেল প্লাতিনি : উয়েফার তখনকার সভাপতি, ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। এখন তিনি ফুটবল থেকে ৪ বছরের ব্যান সামলে দূরে আছেন।।
ঈশা হায়াতৌ: ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন । তিনি পার্লামেন্টে অভিযুক্ত হয়েছিলেন মোটা অর্থের বিনিময়ে কাতারকে নিজের ভোট দিয়ে দেওয়ায়। আনুমানিক অর্থের পরিমান ছিল ১.৫ মিলিয়ন ডলার! শুধু তাই টিভি সম্প্রচার চুক্তির জন্য কাটমানি নেওয়ার অভিযোগও ছিল তাঁর বিপক্ষে। তিনি নিজে দুটি অভিযোগের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাসে ক্যামেরুনের এই কর্তাটি ফুটবল থেকে এক বছরের জন্য ব্যান হওয়া থেকে মুক্তি পান । এটা করেছে কোর্ট অফ আরবিট্রেশন ফর স্পোর্টস ( CAS), সেখানে পর্যাপ্ত তথ্য – প্রমাণ না মেলায়, রেহাই পান।
জ্যাক ওয়ার্নার: ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। ফুটবল থেকে আজীবনের জন্য বিতাড়িত। ত্রিনিদাদ থেকে তাঁকে আমেরিকার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে অপরাধমূলক কাজ কারবারের জন্য।
এঞ্জেল মরিয়া ভিল্লার: তখন ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। এখন বিশ্বকাপ বিডিং প্রক্রিয়া নিয়ে যে তদন্ত চলছে তাতে সহযোগিতা না করার জন্য তাঁকে আর্থিক জরিমানা দিতে হয়েছে। অর্থিক গোলযোগের জন্য ২০১৭ সালে গ্রেফতার হন। ফিফা থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর এই স্পেনের কর্তার উপর থেকে যাবতীয় অভিযোগ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
চুং মং-জুন: সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। ২০২২ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের দাবিদার ছিল দক্ষিণ কোরিয়া। তিনি সেই প্রক্রিয়ায় নিয়ম বিরুদ্ধভাবে জড়িত ছিলেন। ফিফার এথিক্স কমিটি ৬ বছরের জন্য সাসপেন্ড করেছিল। তিনি সি এ এস ( CAS) এর কাছে আবেদন করে সেই মেয়াদ ১৫ মাস করেন। যা ২০১৮ সালে শেষ হয়ে গেছে।
মিচেল ডি’হুঘে: ফিফার অন্যতম এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। এখন স্বীকার করে নিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার ২০১৮ সালের বিশ্বকাপ বিডিংয়ে ছোট একটি পেইন্টিং নিয়েছিলেন গিফট হিসেবে সেই ফুটবল সংস্থার এক পরামর্শদাতার থেকে। তাঁর ছেলে পিটারকে কাতার বিশ্বকাপ ভোট পর্ব মিটতেই কাতার স্পোর্টস হাসপাতালে চাকরীর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি তদন্তকারীদের স্পট জানান : কাতারকে ভোট দিয়ে বদলে ছেলের চাকরীর ব্যবস্থা করেননি। ফিফার এথিক্স কমিটি তাঁকে ক্লিনচিট দিয়েছিল। এই বেলজিয়ান কর্তা এখনও ফিফাতে আছেন।
রিকার্ডো তেইসিরা: তিনিও তখন ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। বিশ্বকাপের টিভি রাইটস ডিলে তিনি ঘুষ নিয়েছিলেন – এটা সেই অপরাধের তদন্তে উঠে এসেছিল। এটা ব্লাটারের অজানা ছিল না। সেইসময় সুইস আইনের চোখে এই ধরনের কাজে আর্থিক লেনদেন অপরাধ বলে ধরা হতো না। কিন্তু এই ব্রাজিলীয় কর্তাটি ফুটবল দুনিয়া থেকে বাকি জীবনের জন্য বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
মহম্মদ বিন হাম্মাম: তিনি তখন ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এই কাতার কর্তা। এখন ” কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট” এর কারণে সারা জীবনের জন্য ফুটবল থেকে বহিষ্কৃত।
চুক ব্লাজের: তিনি তখন ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। তদন্তে স্বীকার করে নিয়েছেন, অন্য অনেক ফিফা কর্তার মত তিনিও বিশ্বকাপ আয়োজনের নানান বিডিং এর জন্য অর্থ ঘুষ নিয়েছিলেন। তিনি আজ মৃত, কিন্তু রাজস্বাক্ষী হয়ে এই অপরাধমূলক মার্কিন তদন্তে জট খুলতে সাহায্য করেছিলেন
চুক ব্লাজের: তিনি তখন ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। তিনিও স্বীকার করে নিয়েছিলেন ফিফার বাকি কর্তাদের মতন বিভিন্ন বিশ্বকাপের বিডিংয়ের থেকে ঘুষের অর্থ পেয়েছিলেন।
ওয়ারাউই মাকুদি: তিনি তখন ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ৫ বছরের জন্য ফুটবল থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন। ফিফার নির্বাচনের প্রক্রিয়াতে ছল চাতুরী করেছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। কিন্তু সি এ এস ( CAS) থাইল্যান্ডের এই অপরাধীর সাজা মাপ করে দেয়।
নিকোলাস লিওজ: তিনি সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। ১৯৯০ সালে ফিফা বিশ্বকাপের টিভি স্বত্ত্ব বণ্টনে মোটা অর্থ ঘুষ নেন। শোনা যায়, ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ করার দায়িত্ব পাইয়ে দিতে দিলে তাঁকে নাইটহুড খেতাব আর এফ এ কাপ তাঁর নামে করার দাবি জানিয়ে ছিলেন। ২০১৫ সালে ইন্টারপোল রেড নোটিশ দেয়। পারাগুয়ায়ের এই ফুটবল কর্তা ২০১৯ সালে মারা যান।
ফ্রানজ বেকেনবউয়ার: প্রাক্তন এই স্বনামধন্য ফুটবলাররাটি সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। জার্মানিতে ২০০৬ বিশ্বকাপ হয়েছিল। ২০১৬ সালের তদন্তে জানা যায়, জাল – জোচ্চুরি করে মোটা অর্থ আত্মসাৎ করেছিলেন। ২০২০ সালে এই তদন্ত বন্ধ হয়ে যায়, কোনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হয়েই। তদন্ত করার সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছিল, অন্যায় তিনি কিছু করেননি। একপ্রকার তাঁর ফুটবল শৈলী তাঁকে এই কালিমালিপ্ত বিভীষিকা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
রাফায়েল সালগুয়েরো: তিনি সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। গুয়াতেমালার এই ফুটবল কর্তা একাধিক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা চান ২০১৬ তে। তিনটি বছর তাঁকে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়।
ভিতালি মুৎকো: তিনি সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। এখন তিনি ওয়াডা দোষী সাব্যস্ত করেছে রাশিয়ার স্টেট স্পন্সরড ডোপিং ব্যবস্থার সঠিকভাবে দেখভাল না করায়। অলিম্পিক স্পোর্টস থেকে সারা জীবনের জন্য সাসপেন্ড হন। সি এ এস ( CAS) এর কাছে আবেদন জানিয়ে লাভ হয়নি।
জিওফ থম্পসন: তিনি সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ বিশ্বকাপ বিড কমিটির হেড ছিলেন। এখন আর ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত নন। ফিফা বিড তদন্তের গার্সিয়া রিপোর্টে বলা আছে, ফিফার এথিক্স নিয়ম মানেননি।
মরিস লেফকারিতিস: তিনি সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। সানডে টাইমস এর নিজস্ব তদন্তে জানা যায়, কাতারের এক সংস্থার থেকে ২৭ মিলিয়ন পাউন্ড পেয়ে পারিবারিক ট্যুর করেছিলেন। সাইপ্রাসের এই কর্তা দাবি করেন, তিনি কোনও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন। এখনও ফিফার সঙ্গে যুক্ত।
জাকুস অনৌমা: তিনি সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। কাতারে বিশ্বকাপ হোক – সেই সমর্থনে তিনি ভোট দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই ভোট বেচে ১.৫ মিলিয়ন ডলার নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত। এই আইভরিয়ান কর্তাটি তা অস্বীকার করেন। কিন্তু তাঁর ফিফার পদ গেছে।
যউঁজি অগুরা : তিনি সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত ফিফা কর্তা। একসময় অভিযোগে ছিল, ২০০২ সালের যুগ্ম আয়োজক জাপানকে ( দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে) সমর্থন করার জন্য মধ্যস্থতা করেছিলেন এক সিনিয়র জাপান ফুটবল কর্তার সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল সংস্থার মধ্যে। ভোট টানার জন্য নাকি ১.৫ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছিল। তিনি তা অস্বীকার করেন।
সেনেস এরজিক: তিনি সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। এখন এই তুর্কির ফুটবল কর্তা ফিফা থেকে অবসর নিয়েছেন।
হানি আবো রিদা: তিনি সেইসময় ফিফার এক্সিকিউটিভ সদস্য ছিলেন। মিশরের এই কর্তা এখনও ফিফার সদস্য।
যাঁরা জড়িয়ে ছিলেন নানান ভাবে:
ভ্লাদিমির পুতিন: তখনকার রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। হালে ক্রিমিয়া আক্রমন করেছিলেন। ব্রিটিশ এলাকায় ব্যবহার করেছিলেন রাসায়নিক অস্ত্র। ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। এখনকার ফিফা প্রেসিডেন্ট গিয়ান্নি ইনফানটিনো এই প্রশাসকের প্রচুর প্রশংসা করেছিলেন। এমনকি ২০১৮ সালে ক্রেমলিনে এক ফ্রেন্ডশিপ সেরেমনি করে ঘোষণা করেছিলেন : গোটা বিশ্ব রাশিয়ার ভালোবাসায় আবদ্ধ।
বরিস জনসন: লন্ডনের মেয়র ছিলেন তখন। ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড কাপ বিড দলে ছিলেন। এখন তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারিত। দায়িত্বে থাকতে পুলিশের জরিমানাও দিয়েছিলেন।
রোমান আব্রামোভিচ: সেইসময় চেলসির মলিক ছিলেন। ২০১৮ রাশিয়ার বিশ্বকাপ বিড টিমের অ্যাম্বাসেডর ছিলেন। এখন ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া শর্তে তিনি কোণঠাসা, কারণ তাঁর সঙ্গে ক্রেমলিনের যোগ পাওয়া যায়। চেলসির মালিকানা থেকে সরে যেতে হয়।
ডেভিড ক্যামেরন: তখনকার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনিও এফ এ’র (FA) ২০১৮ বিশ্বকাপ বিড টিমে ছিলেন। এখন ব্রিটেন বেরিয়ে গেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে। সেইসঙ্গে তিনিও পদত্যাগ করেছেন।
ডেভিড বেকহ্যাম: ব্রিটিশ বিশ্বকাপের জন্য তিনি ছিলেন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। কিন্তু তিনি এই বিডিং প্রক্রিয়া দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হন, দেখেন কাতার ২০২২ বিশ্বকাপ পেয়ে গেছে। আর এখন! তিনিই আবার কাতার বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর।
Leave a Reply