পাকিস্তান প্রেম, কেমন আছেন বাঙালিরা? ফিরে দেখা ‘পাক-দেশপ্রেম’

স্বাতী চ্যাটার্জিসময়টা ইংরেজ শাসনকাল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ। লর্ড কার্জন ভেঙে দিলেন বাংলাকে। প্রবল বিক্ষোভ শুরু হল, প্রথম দিকে ঢাকার নবাব খওয়াজা সালিমুল্লা বাহাদুর আপত্তি করলেও, রাতারাতি ডিগবাজি খেলেন। হয়ে গেল বঙ্গভঙ্গ।

একটা অংশ বলতে শুরু করলো নবাব বাংলা ভাগ করতে চাননি, তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছিল। আর একটি অংশ বলতে লাগল, কার্জন ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ঢাকার নবাবকে দলে টানে। ঘটনা যাই হোক ঢাকার নবাব বঙ্গভঙ্গ মেনে নিয়েছিলেন এটা ইতিহাস। কিন্তু তার উদ্দেশ্য বা স্বপ্ন কী ছিল? একটাই স্বপ্ন নিজেদের স্বপ্নপূর্ণ, মুসলিমদের জন্য একটি অখণ্ড ভূমিখণ্ড।

১৯০৬ সাল নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হল মুসলিম লিগ। ভারতে প্রথম ধর্মীয় ও জাতিগত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক দল। প্রশ্ন ওঠে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তখনতো জাতীয় কংগ্রেস তৈরি হয়ে গিয়েছিল, তাহলে আরও একটি নতুন দল কেন? কারণটা স্পষ্ট, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের যে লড়াই ছিল, তা প্রায় সিহের সঙ্গে ছোট কচ্ছপের লড়াই।

এলিট কংগ্রেস নেতারা বছরে একবার-দুবার করে বৈঠক করে আর অ্যাসেম্বলিতে কীভাবে পর্যুদস্ত করা যায়, তার রূপরেখা তৈরি করতো। অন্যদিকে, ভারতের নাগরিকদের উপর ইংরেজদের অত্যচার বাড়তেই থাকলো। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে, কংগ্রেসের মধ্যেই একটা অংশ চরমপন্থীদের জন্ম দিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, কংগ্রেস যেভাবে পথ চলছে, সেভাবে দেশের স্বাধীনতা সম্ভব নয়।

অন্যদিকে, এক ব্রিটিশ আধিকারিক মহম্মদ আলি জিন্নাকে বোঝালেন, তোমরা কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় লড়াই করলে কল্কে পাবে না, তাই আলাদা ভূখণ্ডের দাবিতে লড়াই করো। জিন্না সেই পথ ধরলেন। ১৯০৬ সালে ঢাকার নবাবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হয়ে গেলেন মুসলিম লিগের নেতা।

তারপরের ইতিহাস অনেকেরই জানা, এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হল, তৈরি হল পাকিস্তান। ভারত ভূমিখণ্ড হারিয়ে নিজের মতো করে পথ চলতে শুরু করলো। কিন্তু জ্বালা শুরু হল পূর্ব ও পশ্চিমপাকিস্তান নিয়ে। অধিকাংশ কর উঠে আসত পূর্ব পাকিস্তান থেকে, কিন্তু তাদের কপালে ঠেকত মাত্র ছিটেফোঁটা।

অর্থাৎ পাকিস্তানের ৬০ শতাংশ কর উঠত পূর্ব পাকিস্তান থেকে। আর পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নে দেওয়া হত ওই ৬০ শতাংশকে ১০০ শতাংশ ধরে, তার ৩৫ শতাংশ। আর পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের ঠাট বাট, বিদেশ ভ্রমণ, বৈভব বাড়তে শুরু করলো। তারপরের ইতিহাসও সবার জানা।

কিন্তু এখানেই ছিল একটি ট্যুইস্ট, ১৯৪৭ সালেই দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের একটা বড় অংশের বাঙালি চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। সেই বাঙালিরা লড়াই চালাতে থাকে পূর্বের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালে ভারতের সহযোগিতায় পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ। সেই লড়াইয়ে, ভারত-পাকিস্তান লড়াই এমনকি ভারত চিন যুদ্ধেও ভারতের বিরুদ্ধে প্রক্সি ওয়ারে নেমেছিল পাকিস্তানে থাকা বাঙালিরা।

কিন্তু এখন তারা কেমন আছে? না পাকিস্তানের প্রতি দেশ প্রেম দেখিয়ে তারা এখনও ভালো নেই। তারা এখনও নাগরিকত্ব পাননি, দেশের রেশন ব্যবস্থায় তাদের নাম নেই। দেশের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তাদের নাম নেই। তাদের বাচ্চারা এখনওসরকারি স্কুলে পড়তে যেতে পারে না। কোনও বিপর্যয় এলে, তারা এখনও কোনও ত্রাণ পান না।

তাহলে তাদের জীবনধারণ কেমন ভাবে চলছে?

ভিক্ষাবৃত্তি করে, বা কোনও বাড়িতে বাসন মেজে, অপঞ্জীকৃত ঠিকাশ্রমিক হিসেবে আর অধিকাংশ মহিলাই কিশোরী বয়স থেকে পা রাখছে দেহ ব্যবসায়।

তাদের দুঃখ, তারা, তাদের বাপ ঠাকুরদারা আলাদা ভূমিখণ্ডের জন্য ইংরেজ ও ভারতীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। ১৯৪৭ সালে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়। তারপর বাংলাদেশ তৈরি হলেও, তার বিরুদ্ধে তারা লড়েছিল দেশ বাঁচাতে। কোনও সরকারি সুবিধা ছাড়াই যুদ্ধে গিয়েছিল। বাপ, ঠাকুরদারা কোনও সরকারি সুযোগ সুবিধা পাননি। পেয়েছেন শুধু বঞ্চনা আর প্রতিশ্রুতি।

পাকিস্তানে প্রায় ৫০ লক্ষ বাঙালি রয়েছে। ১৯৫১ সালের পাকিস্তান নাগরিক আইন অনুসারে, ওই সময় থেকে যাঁরা পাকিস্তানের ভূখণ্ডে জন্ম নেবে, তারাই পাকিস্তানের জন্মগত নাগরিক। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও বাঙালি পাকিস্তানের নাগরিকত্ব পাননি।

এখানেও একটা প্রশ্ন আসে, বাঙালিদের জন্য, একটা আলাদা রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে, নাম বাংলাদেশ। তাহলে সেখানে ফিরে আসছে না কেন? উত্তরটা হল, নিরাপত্তাহীনতা। এরাই বাংলাদেশের কাছে রাজাকার, গদ্দার বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকার এদের নাগরিকত্ব নাও দিতে পারে এই আশঙ্কা রয়েছে। যদিও এখনও বাংলাদেশের মধ্যে একটা বড় অংশের মানুষ আছেন, যাঁরা পাকিস্তানের বাঙালিদের জন্য সওয়াল করেন, তাদের বাংলাদেশে জায়গা দেওয়ার দাবি জানান।

আরও পড়ুন- কীভাবে হয় পারসিদের অন্ত্যেষ্টি? জানলে চমকে যাবেন

তারা পাকিস্তানে দিন মজুর, ভিক্ষাবৃত্তি করে বেঁচে আছে, বাংলাদেশে ফিরলে তারা বেঁচে থাকবে এমন কোনও গ্যারেন্টি নেই। তাই এখনও তারা পাকিস্তান সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছে, কৃপার আশায়।

গত ৭৫ বছরে পাকিস্তান সরকারে বহু বদল এসেছে, কিন্তু ইসলামাবাদের এদের নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। পাকিস্তানের বাঙালিদের অধিকাংশ বাস করাচিতে। সেখানের তারা জল ব্যবহার করছে, নিকাশী নালা ব্যবহার হচ্ছে, পরিকাঠামোয় চাপ সৃষ্টি করছে, অথচ এতো বিপুল সংখ্যক নাগরিককে হিসেবের আওতাতেই আনা হচ্ছে না। এতে যে পাকিস্তান সরকারের পরক্ষোভাবে ক্ষতি হচ্ছে, সেটুকুও তারা ধর্তব্যের মধ্যে আনতে পারছে না।

পাকিস্তানে থাকা এখনকার যুবা নাগরিকরা কীভাবে দেখছে?

১৯৭১ সালে কঠোর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নতুন করে জায়গা করে নিচ্ছে বাংলাদেশ। বিপুল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়নে পাকিস্তানকে পিছিয়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। ফলে, এই সাফল্য পাকিস্তানের কাছে ঈর্ষনীয়। পাকিস্তানের নব প্রজন্মের যুবক-যুবতীদের কাছে বাংলাদেশীদের প্রতি একটা প্রীতির জন্ম দিচ্ছে। তারাও বাংলাদেশ নিয়ে কৌতুলহল শুরু করেছে।

আরও পড়ুন- এখনও বেঁচে আছে মহাভারতের অশ্বত্থামা? কোথায় দেখা যায়?

তারা প্রত্যেকেই এক বাক্যে স্বীকার করছে, এখনও পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তর ইতিহাসকে চেপে রাখা হয়েছে পাকিস্তানে। কেন বাংলাদেশ আলাদা হল, তার ইতিহাস স্কুল, কলেজের ইতিহাসে পড়ানো হয় না। ব্রাত্যই করে রাখা হয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে সেই ইতিহাস আজ হাতের মুঠোয়। তারাও এখন জানতে পারে, একটা সময় কত ধরণের বঞ্চনা করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি।


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *