T20 World Cup: বেশ কিছু সমস্যা সামলে আমরা এখন তৈরি, দাবি রোহিতের

দীপঙ্কর গুহ:

খুব মন দিয়ে ভিডিও ক্লিপগুলো শুনছিলাম। শুনছিলাম ভারতীয় দলের অধিনায়ক রোহিত শর্মার কথাগুলো। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত খেলতে নামছে এবার। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। এই মুহুর্তে দুই দেশ নিয়ে এখন বিস্তর বিতর্ক। তারই মাঝে এই ম্যাচ। সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে।

ম্যাচের আগে সাংবাদিক সম্মেলনেই জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের উত্তরে রোহিতকে বলতে শুনলাম: ” শেষ বিশ্বকাপ থেকে আজ পর্যন্ত আমরা খুব সচেতন। এক বছর আগে আরব নগরীতে কী কী ভুল আমরা করেছি, তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আর কী কী সমস্যার মধ্যে দিয়ে গেছি – সব বুঝেছি। এরপর এখন আমরা তৈরি। সব দেশের চেয়ে বেশি সংখ্যায় আমরা ম্যাচ খেলে নিয়েছি। তাতে জয়ের শতকরা হার বেশী। এইসবের মধ্যে আমরা হারা – জেতা নিয়ে বেশী মাথাই ঘামায়নি। আমরা আমাদের খামতি নিয়ে কাজ করে গেছি। “

রোহিতের কথা বলায় জমাট আত্মবিশ্বাস দেখলাম। তিনি যখন বললেন, “এই ম্যাচটা নিয়ে টেনশন আছে – এটা ঠিক নয়, আমরা এই ম্যাচটাকে চ্যালেঞ্জ বলে নিয়েছি।” এটা শোনার পর মনে হল, মোটেই মনগড়া কথা বলেছেন না নেতা। শেষ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই পাকিস্তানের কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল ভারত। আবার সেই মরু শহরে এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলা হয়নি, এই পাকিস্তানের কাছে হেরে। চলতি বছরে এবার তৃতীয় বার মুখোমুখি হওয়া। রোহিত – রাহুল, কোহলি – দ্রাবিড়দের কাছে তো এই ম্যাচ চ্যালেঞ্জই বটে।

এই বিশ্বকাপের আগে ৩৫ টি ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে। টিম ম্যানেজমেন্টের নিশ্চিতভাবেই বোঝা হয়ে গেছে – দল হয়ে মাঠে নামলে ঠিক কী কী করতে হবে। ব্যাটিংয়ে কী করা দরকার। বোলিংয়ে কী করে যেতে হবে। আর ফিল্ডিংয়ে কী দরকার।

রোহিতের কথায় : ” হ্যাঁ, আমরা বিশ্বকাপ খেলার জন্য পুরো প্রস্তুত। অনেক কিছু পরীক্ষা করা হয়েছে। অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে আমরা গেছি। সব সামলে নিয়ে , আমরা এবার মাঠে নানার জন্য তৈরি।”

শুধু ম্যাচ জেতায় খুশি থাকতে চায় না টিম ইন্ডিয়া? মুখে রোহিত যতই বলুন, একটা একটা করে ম্যাচ নিয়ে ওঁরা এগুতে চায় – সেমি ফাইনাল আর ফাইনাল নিয়ে এখনই ভাবতে চান না , মনে তীব্র খিদে ট্রফিটার নাগাল পাওয়ার।

কেনই এটা মনের মধ্যে থাকবে না! অনেক গুলো বছর হয়ে গেল, ভারত আইসিসির টুর্নামেন্টে সাফল্য পায় নি। শেষবার সেরা হওয়া সেই ২০১৩ সালে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়। আজ ৯ বছর পর দলের সকলের মনে মহা খিদে।

এই বিশ্বকাপ টিভি সম্প্রচার স্বত্ব যাদের হাতে, সেই স্টার স্পোর্টসের অ্যাংকর – কাম – রিপোর্টারকে এম সি জি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কোহলি যখন বলেন, ” বিশ্বকাপ শুনলেই শরীরের ভিতর কী সব যেন হতে থাকে। আর এই অস্ট্রেলিয়া মানেই যেন, অন্য কিছু। বাড়তি অ্যাড্রিনাল ক্ষরণ শুরু হয়ে ভিতরে। দেখা যাক।” সহজ করে মনের দরজা খুলে আর কী ই বা বলার বাকি রইলো! কোহলি কাঁপিয়ে দিলেন যে!

এক বন্ধু সাংবাদিকের মেলবোর্ন থেকে ৪-৫ টা ছবি দেখে বুঝলাম, হেড কোচ রাহুল দ্রাবিড়ও ব্যাট হাতে নেমে পড়তে চাইছেন। ১৫-২০ মিনিট তো বটেই, আধঘন্টা হলেও অবাক হব না – দ্রাবিড় যেভাবে ২২ গজের পিচে ঘোরা ফেরা করলেন। এপাশ থেকে ওপাশ। দুই পাশের উইকেট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। আঙ্গুলের টোকা মেরে বোঝার চেষ্টা করেছেন – শব্দটা কেমন? শক্ত – জমাট? নাকি একটু ফাঁপা? আরে, তিনি আর ভি ভি এস তো অস্ট্রেলিয়া খেলতে নামার আগে এইভাবেই প্রস্তুতি নিতেন। সত্যি স্বভাব যায় না মোলে!

এতে আখরে লাভ হবে টিমের। সকলে জানি, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে মাঠে ভারত-পাকিস্তানের লড়াই মনে প্রথম দলের ব্যাটারদের সঙ্গে লড়াই দ্বিতীয় দলের বোলারদের। ২০০৭ সালে প্রথম টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই রাহুলই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের শেষ পর্বে প্রথম সিনিয়র হয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন – এই ফরম্যাটে তিনি খেলতে চান না। সঙ্গে পেয়েছিলেন সচিন। দুই সাথীকে দেখে নিমরাজি সৌরভও সরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জোহানেসবার্গের ফাইনালে এই পাক দলকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে দেশে ফিরেছিল – ধোনি বাহিনী। এবার রাহুল দলের হেড কোচ। সচিন তেন্ডুলকর তো বলেই দিয়েছেন, তাঁর বাজি ভারতে।

আইসিসি টি টোয়েন্টি ক্রমতালিকায় ভারত এখন পয়লা নম্বরে। এই টুর্নামেন্ট খেলতে নামার আগে দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে এসেছে হোম সিরিজে। ক্রিকেটারদের উপর চাপ কমাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ২৯ জন ক্রিকেটারকে খেলানো হয়েছে। তার থেকে ১৫ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। টিম ইন্ডিয়া দেশে আর বিদেশে টি টোয়েন্টি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলেছে। অধিকাংশ জিতেছিল। শুধু জুনে দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২-২ হয়। আর আরবের মাটিতে এশিয়া কাপে হার। এই হল, আপাত ব্যর্থতা।

নেতা রোহিত – কোচ রাহুল জুটি দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা ক্রিকেটারকে নানানভাবে টিমে ব্যবহার করেছে। উইকেটকিপার স্লটে প্লেয়ারদের পরখ করে দেখা হয়েছে। প্রথম পাওয়ার প্লে তে , ৬ ওভারকে কে কে কিভাবে কাজে লাগাতে পারে , সেটাও দেখা হয়েছে। তাই হয়তো রোহিত এদিনও বলতে পারলেন, “ওপেনিংয়ে রদবদল হয়ে ম্যাচ বুঝে”। ভারতের নেতার দাবি, ক্রিকেটারদের উপর থেকে চাপ সরিয়ে ভরসা দেওয়া হয়েছিল। সকলে জানতেন, টিম ম্যানেজমেন্ট ম্যাচের রেজাল্ট নিয়ে চিন্তিত নয়। যে যে পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে, তা ঠিকঠাক পালন করার দিকে সকলের নজর ছিল। সেটাই নাকি কাজে দিয়েছে , এই এক বছরে। ভয়হীন ক্রিকেট খেলাই নাকি চালিয়ে যাওয়া হয়েছে।

দলের সঙ্গে গত ৬ মাস হল, কাজ করে চলেছেন মনোবিদ প্যাডি আপটন। ক্রিকেটারদের বলে চলেছেন। ক্রিকেটাররা মন খুলে বলে চলেছেন। বরাবরই টিম ইন্ডিয়া এইসব বিশ্বকাপ খেলতে গেছে, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়াই। এক বছর আগে, আরব দুনিয়ার বিশ্বকাপই ধরি। আইপিএল খেলেই খেলতে নেমে গিয়েছিল টিম ইন্ডিয়া। সাফল্য আসেনি। এবারের গপ্পোটা কিন্তু অন্য রকম। প্রস্তুতিতে আছে – পরিকল্পনার ছাপ। বোর্ড সভাপতি থাকতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় জাতীয় দলের জন্য রাহুল দ্রাবিড়কে রাজি করান। দলে নুতন অক্সিজেন আনেন সৌরভ ক্রিকেট মস্তিষ্ক খাটিয়ে। তখনই রাহুল – রোহিতদের সঙ্গে লেগে ছিলেন জাতীয় নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান চেতন শর্মা। তাই এক বছরে দেশে আর দেশের বাইরে ৩৫ টি টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছে টিম ইন্ডিয়া। দিন ১৫ আগে দলবল নিয়ে অস্ট্রেলিয়াতে ঢুকে পড়েছিলেন রাহুল – রোহিতরা। পার্থে ক্যাম্প শুরু করে। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে দুটি প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলে নেওয়া হয়। এরপর ব্রিসবেনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটি ওয়ার্ম আপ ম্যাচ খেলে নেওয়া গেছে। নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে ম্যাচটা বৃষ্টিতে ভেস্তে যায়।

রোহিতকে বলতে শুনলাম,” এটা নিয়ে আমরা অনেক আলোচনা করে ছিলাম। বড় সফর , বিশেষ করে দেশের বাইরে খেলতে গেলে – আলাদা প্রস্তুতি চাই। সেখানে গিয়ে টিম যেভাবে খেলতে চায় – তারজন্য প্রস্তুতি দরকার। আর সেটা করার জন্য সময়ও চাই। সেটা হয়েছে এবার।”

আসলে , প্রথমে রবীন্দ্র জাদেজা আর পরে জশপ্রীত বুমরা চোটের ধাক্কায় খেলতে না পারায়, আগের সাজানো ছক বদলে যায়। তারসঙ্গে আছে অজিদের ডেরায় এই দলের না খেলার অনভিজ্ঞতা। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় মূল দলের ক্রিকেটাররা দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ান ডে সিরিজ না খেলে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দিয়েছিল – প্ল্যানিং বদলে। এই দলের হার্শাল প্যাটেল ( ২০০৯ সালে) আর দীপক হুডা ( ২০১৩ সালে) আন্ডার-১৯ জাতীয় দলের হয়ে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল। কিন্তু সূর্য কুমার যাদব, অক্ষর প্যাটেল আর আর্শদীপ সিং – এই প্রথমবার সে দেশে ক্রিকেট খেলতে গেছেন। তাই পার্থ আর ব্রিসবেনে ১৫ দিনের প্রস্তুতি কাজে লেগেছে।

রোহিত নিজেই বলেছেন: ” পার্থে আমাদের চুটিয়ে অনুশীলন হয়েছে ৯ দিন ধরে। তারপর আমরা ব্রিসবেন গেছি। সেখানে প্রস্তুতি চলেছে। প্র্যাকটিস ম্যাচে দুটো খেলেছি। এখনকার আবহাওয়া আর উইকেটের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া গেছে। গোটা অস্ট্রেলিয়া ঘুরে ঘুরে তো আর প্রস্তুতি নেওয়া যায় না। যেটুকু আমরা পেয়েছি, সেটাই কাজে লেগেছে।”

এখনও পর্যন্ত তিনটি ম্যাচ রোহিতের হয়ে কথা বলছে। দুটিতে জয়, একটিতে হার। সব ক্রিকেটার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলেছে। পার্থে তাই শুরু হওয়াটা ভালোই হয়েছে। ভারতের সঙ্গে সাড়ে চার ঘণ্টার ব্যবধান। মানি আর না মানি – এসব কিন্তু মাঠের পারফরমেন্সের উপর প্রভাব ফেলে। যা যা খবর মিলেছে, তাতে জানলাম – পরিকল্পনার ম্যাপ সামনে ফেলে প্রস্তুতি নিয়েছে দল। ব্যাটিং – বোলিং সবেতেই। এসব সেরে এবার দল মেলবোর্নে।

রোহিতরাও পুরো দস্তুর প্রস্তুত। তাই তিনি বলতে পেরেছেন, ” আমাদের পরিকল্পনাগুলো এবার মাঠে করে দেখানোর পালা। সব কিছু নিজেদের মধ্যে বারবার আলোচনা করা হয়ে গেছে। দেখুন, কোনও দল একশো শতাংশ ঠিক করতে পারে না। হয়ও না। কিন্তু একটা দল হয়ে যতটা পারা যায়, ততটা করে দেখাতে চাই। আমরা একটা দল হয়ে কিছু করে দেখানোর জন্য প্রস্তুত।”

বিস্তর পজিটিভ এনার্জি নিয়ে দৌড় শুরু হচ্ছে রোহিত বাহিনীর। আমরা দর্শক।