আধ্যাত্মিকতা আর ভ্রমণের নেশা এই দুইয়ের একটি চমৎকার মেলবন্ধন ঘটতে পারে তারাপীঠে। তারাপীঠ হল শক্তিপীঠগুলির অন্যতম একটি। এখানে সতীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল বলে মনে করা হয়। বীরভূম জেলার সাহাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের একটি ছোট গ্রাম হল তারাপীঠ। দ্বারকা নদীর তীরে অবস্থিত।
এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিভিন্ন জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। প্রথম জনশ্রুতি অনুসারে সতী বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। তারাপীঠে সতীর তৃতীয় নয়ন পড়েছিল বলে মনে করা হয়। অন্য একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী বশিষ্ট তারা মায়ের দর্শন লাভের জন্য কঠিন তপস্যা শুরু করেন। তারপর তিনি বিষ্ণুর অবতার বুদ্ধের সাথে দেখা করেন। বুদ্ধ বশিষ্টকে তারা পুজোর পদ্ধতি শেখান। এরপর বুদ্ধের পরামর্শ মত তিনি তারাপীঠে গিয়ে সাধনা করেন এবং মায়ের দর্শন লাভ করেন।
আধ্যাত্মিকতা এবং প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তির মেলবন্ধনের স্বাদ পাওয়ার জন্য পর্যটকদের কাছে তারাপীঠ একটি উপযুক্ত ভ্রমণের স্থান হতে পারে। এই জায়গার মূল আকর্ষণই তারা মায়ের মন্দির। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িত সাধক বামাক্ষ্যাপার কিংবদন্তিও অনেক কৌতুহলী মানুষকে টেনে আনে এখানে। তারাপীঠের আরেকটি মূল আকর্ষণ হল সেখানকার মহাশ্মশান। সে-জায়গাটি তান্ত্রিক সাধকদের সাধনভূমি স্বরূপ। ফলে পর্যটকদের যে বেশ এক রোমহষর্ক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ রয়েছে এই তারাপীঠে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তারা মায়ের মন্দিরটি মার্বেল এবং টেরাকোটার মিশ্রণে নির্মিত। প্রধান মন্দিরের পথে বেশ অনেকগুলি ধাতু নির্মিত বড় দরজাও পড়ে। সেগুলির ওপরে আবার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতীকের জটিল নকশা খোদাই করা আছে। এইসব নির্মাণশৈলীও যে-কোনো শিল্পবোদ্ধার কাছে এক উপরি পাওনা। মন্দিরের স্থাপত্যতে গ্রাম বাংলার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। মন্দিরটি চারচালার ধাঁচে নির্মিত ও এর চার কোণে চারটি চূড়া রয়েছে। মা তারার আসল যে পাথরের মূর্তি রয়েছে সেটি তিন ফুট উঁচু একটি ধাতব মূর্তির আবরণের মধ্যে রাখা থাকে। এই ধাতব মূর্তির রূপটি হল মা চতুর্ভুজা, এলোকেশী,কপালে সিঁদুর লেপা, লাল জিহ্বা, পরনে লাল শাড়ি আর মাথায় রয়েছে রূপার মুকুট। এবং বিগ্রহের নিচে রাখা থাকে দুটি রূপার পাদ পদ্ম। যেখানে ভক্তরা তাদের মনের ইচ্ছা জানিয়ে মা তারার উদ্দশ্যে পুজো দিয়ে থাকে।
মন্দির সংলগ্ন মহাশ্মশানে ঘুরে বেড়ানোর রোমাঞ্চকর এবং গা ছমছমে অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই। নিস্তব্ধ, নির্জন সেই মহাশ্মশানই কত তান্ত্রিক সাধকদের আস্তানা। মহাশ্মশান ছাড়াও তার চারপাশে আরও বহু প্রাচীন মন্দির রয়েছে। বামাক্ষ্যাপার মন্দির। গোলাপী ও লালরঙের এই মন্দির তান্ত্রিক সাধক বামাক্ষ্যাপাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। মন্দিরের বাইরেই রয়েছে একটি সমাধি সেখানে বহু মানুষ এসে সাধুর নামে প্রার্থনা করে এবং নৈবেদ্য দেয়।
তারাপীঠ মন্দির থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বীরভূমের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির মধ্যে একটি মল্লারপুর শিবমন্দির। প্রায় ৮০০ বছরের পুরোনো এই মন্দিরের চারদিকে মোট ২১টি পুকুর রয়েছে। তারাপীঠ থেকে ওই ১০ কিমির দূরত্বেই আবার রয়েছে বীরচন্দ্রপুর মন্দির। এটি বৈষ্ণবধর্মের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্বামী নিত্যানন্দের জন্মস্থান বলে মনে করা হয়। এই মন্দিরের ইতিহাস আনুমানিক ৩০০ বছরেরও বেশি। বীরচন্দ্রপুরে আরও কিছু পুরোনো মন্দির যেমন আছে তেমনি রয়েছে ইসকন মন্দির। এছাড়াও কামদেব ব্রহ্মাচার্য দ্বারা নির্মিত প্রায় ৫০০ বছর প্রাচীন লক্ষ্মী মন্দিরও একটি দ্রষ্টব্য স্থান।
Leave a Reply