ইতিহাসের পথ ধরে বর্তমানে মিঞাপুর থেকে মায়াপুর

বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের যে কয়টি পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে তার মধ্যে মায়াপুর অন্যতম প্রধান। নবদ্বীপের মতো প্রাচীনত্বের গন্ধ না থাকলেও বেশ সাজানো গোছানো স্বচ্ছ-সুন্দর এই মায়াপুরের প্রশান্তিময় পরিবেশ কিংবা ইস্কন মন্দির প্রাঙ্গনের সৌন্দর্য চোখের শান্তি।

নদীয়া জেলার ছোট্ট এক জনপদ মায়াপুর ভাগীরথী নদীর পূর্ব দিকে অবস্থিত। জলঙ্গী নদী এসে মিশেছে এই ভাগীরথী নদীতে। এখানে তাই জলের রঙও আলাদা। নদীয়ার নবদ্বীপের একেবারে সংলগ্ন এই মায়াপুর জনপদটি।

ঐতিহাসিক দিক দিয়ে মায়াপুরের গুরুত্ব অপরিসীম। শোনা যায়, সেন বংশের বল্লাল ঢিপি ও চাঁদ কাজীর সমাধির জন্য একসময় এই স্থানের নাম ছিল ‘মিঞাপুর’। পরে মায়াপুর নামের উৎপত্তি হয়। অনেকেই মনে করেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান হিসেবে মায়াপুর বিখ্যাত৷ তবে শ্রীচৈতন্যের জন্ম মায়াপুরে নাকি নবদ্বীপে এই নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে।

মায়াপুরে আজকে যে বিরাট ইস্কনের মন্দির গড়ে উঠেছে তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন অভয়চরণ দে। ভক্তিসিদ্ধান্তের কাছে দীক্ষিত হয়ে তিনি প্রথমে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেস’ বা ‘ইসকন’। তারপরে ১৯৭২ সালে মায়াপুরে এসে তিনি এখানেও একটি ইস্কন মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ইস্কন মন্দিরের সৌজন্যেই মায়াপুর শ্রীচৈতন্যের জন্মভূমি হিসেবে বহুল প্রচারিত হয়েছে। মায়াপুরের আরেকটি বিশেষত্ব হল এখানে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ আসে রথে করে।

এই প্রসঙ্গে একটি সুন্দর পৌরাণিক কাহিনী আছে। অতীতে মায়াপুর এবং রাজাপুর পাশাপাশি দুটি গ্রাম ছিল যার মধ্যে রাজাপুরের বেশিরভাগ বাসিন্দাই ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। প্রায় পাঁচশো বছর আগে এক পুরোহিত স্বপ্ন দেখেন রাজাপুর থেকে মায়াপুরে যাবার ইচ্ছে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার। আবার সেখান থেকেও তাঁরা রথে চড়েই ফিরে আসবেন। এই স্বপ্নাদেশ মেনেই প্রতি বছর রথযাত্রা পালিত হয় মায়াপুরে।

চন্দ্রোদয় মন্দির : এটিই মায়াপুরের মূল মন্দির। এই মন্দিরের ভোরবেলা এবং সান্ধ্যকালীন আরতি অবশ্য দ্রষ্টব্য। মন্দিরের মূল বিগ্রহ রয়েছে রাধা-কৃষ্ণ এবং জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার। এখানে শ্রীকৃষ্ণের জীবন কাহিনী প্রদর্শিত হয়েছে সুন্দর চিত্র ও মূর্তি সহযোগে। এই প্রদর্শনী দেখার সময় সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা এবং বিকেল ৪টে থেকে সন্ধ্যা ৬টা। অন্য সময় মন্দিরে প্রবেশ করতে পারলেও প্রদর্শনী দেখা যাবে না এবং মূল বিগ্রহটিও পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকবে।

সমাধি মন্দির : ইস্কন মন্দিরের মূল ফটকের ডান দিকে এই সমাধি মন্দিরে প্রতিষ্ঠাতা শীল প্রভুপাদের বর্ণাঢ্য স্মৃতিমন্দির দেখা যায়। মন্দিরের দোতলায় প্রভুপাদের ব্যবহৃত জিনিসের সংগ্রহশালা দেখা যায়। সকাল ৭.৩০ থেকে বেলা ১.০০টা পর্যন্ত এবং পরে আবার দুপুর ৩.৩০ থেকে রাত ৮.৩০ পর্যন্ত এই মন্দির দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে।

ভজন কুটির : মন্দিরে প্রবেশের পথে বাঁদিকেই খড়ের ছাউনি দেওয়া এই মন্দিরে বহু দেশি-বিদেশি ভক্তের সমাবেশ দেখা যায়।

গোশালা : ইস্কনের মন্দির প্রাঙ্গণের ভিতরেই রয়েছে নিজস্ব গোয়ালঘর যেখানে প্রায় ২০০টি গরু রয়েছে। এই গরুর দুধ থেকে উৎপাদিত ঘি, দই, মাখন, ক্রীম, পনির সবই গোশালা সংলগ্ন কাউন্টারে বিক্রি হয়। মন্দিরের বৈষ্ণব ভক্ত ও সেবায়েতরাই এই গরুদের সেবাযত্ন করে থাকেন।