দীপঙ্কর গুহ:
কাট টু ক্যামেরা: ১
আয়ুষ্মান খুরানা। বলিউডের অভিনেতা। মুম্বই – চণ্ডীগড় বিমান ছাড়ার জন্য প্রস্তুত। সব যাত্রী উঠে গেছে। টেক অফ করার প্রস্তুতি শেষ। ক্যাপ্টেন নিজের পরিচয় দিয়ে দিয়েছেন। অডিও সিস্টেমে মোবাইল বন্ধ করার নির্দেশ কিন্তু তখনও শোনানো হয়নি। সকল যাত্রীর সেট বেল্ট বাঁধা ঠিক হয়েছে কিনা – এয়ারহোস্টেসরা চেক করে নিয়েছে। আয়ুষ্মান নিজের মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে বসে। ৫ মিনিট দেরিতে ছাড়লো বিমান। কারোর কোনো অভিযোগ নেই! থাকবে কেন? সকলে যে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখছিল। আয়ুষ্মান নিজেও শেষ দুটো ওভার সিটে বসে দেখছেন । ফ্লাইট ক্যাপ্টেন তিনিও মোবাইলে ম্যাচ দেখছেন।
• [ দিওয়ালি উৎসবের জন্য “গাঁও”য়ে ( মুম্বই শহরের বাইরে থাকা মানুষদের এভাবে বলা হয়) ফিরছিলেন আয়ুষ্মান খুরানা। তিনি সেই শেষ দুই বলের লড়াই চাক্ষুষ করা নিয়ে টুইটারে যা লিখলেন, সেই ছবিটাই গোটা দেশের প্রতি কোনায় কোনায় ঘটে গেছে। ]
(আয়ুষ্মান খুরানা বিমান থেকে নেমে লিখেছে) : “আমার এই গল্পটি পরের প্রজন্মের জন্য। পাইলট নিজেও মনে হয় এই ম্যাচটি মোবাইলে দেখছিলেন। পান্ডিয়া আর ডিকে আউট হয়ে গেল। ক্রিজে এল – অশ্বিন। শান্ত মনে দেখল , বলটি ওয়াইড। ছেড়ে দিল। একটা রান। আরও একটা বাড়তি বল। ওয়েল লেফট। ওভারের শেষ বল। ম্যাচের শেষ বল। জেতার রানটাও তুলে নিল। আমি জীবনে কখনও দেখিনি, বিমানের ভিতর সকলে-একসঙ্গে আনন্দে, উচ্ছ্বাসে হাততালি দিয়ে উঠেছে। এসব শ্বাসরোধ করা অবস্থা ঘটছে টিভির পর্দায় , তখন আমরা রানওয়েতে দাঁড়িয়ে! আর যা যা ঘটতে দেখলাম, তাতে বলবো: গ্রেট টাইমিং বাই দি ফ্লাইট ক্যাপ্টেন।
• [ইস্, এমন ঘটনাটা যদি আমি মোবাইলে রেকর্ড করতে পারতাম! আমি স্বীকার করে নিচ্ছি, এই কাজটা সকলের চোখের সামনে করতে এমন অস্বস্তি বোধ করি। তাই নিজেই এই ঘটনার চাক্ষুষ স্বাক্ষী হয়ে রইলাম। ধন্যবাদ টিম ইন্ডিয়া, আর বিরাট – একদিন আগেই আমাদের সকলের জন্য এমন এক দিওয়ালি উপহার দেওয়ার জন্য।”]
এই ছবিটা খুব নাটকীয়ভাবে এক বলি-নায়ক দেখেছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখে তা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন।
কাট টু ক্যামেরা: ২
দেখানো হচ্ছে এক নারীকে। বিরাট ঘরণী। তিনিও এক বলিউড অভিনেত্রী। অনুষ্কা শর্মা। কলকাতায় তাঁদের ছোট্ট মেয়ে ভামীকাকে নিয়ে এক পাঁচ তারা হোটেলে। কিং কোহলি ( King Kohli) , ভিন্টেজ বিরাটের (vintage Virat) অবিশ্বাস্য লড়াই দেখলেন হোটেলে নিজের রুমে বড় টিভিতে। তিনি জানেন- বিরাটের এই লড়াই মাঠের, মাঠের বাইরেরও। নিজের ইনস্টাগ্রামে অনুষ্কা কী কী লিখলেন?
” …আমাদের ছোট্ট মেয়ে ভামীকা। আজ সে দেখলো, তার মাম্মা – ঘরের ভিতর লাফাচ্ছে। চিৎকার করছে। অবাক চোখে দেখছে। আজ সে এসব বুঝতে পারে না। একদিন বুঝবে, তার পাপা – জীবনের কঠিন সময় কাটিয়ে সেরা ম্যাচটি এই দিন খেলে ছিল।”
আর বিরাট? – মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে ফিরে ফোন কথা বলেন তাঁর জীবন- সঙ্গিনী অনুষ্কার সঙ্গে। কোহলির জন্য মোবাইলে টাইপ করে অনুষ্কার ডিজিটাল বার্তার উত্তরে লিখলেন: ” তুমি প্রতিটা সময় আমার পাশে থেকেছো। আমি কৃতজ্ঞ তোমার কাছে। অনেক ভালোবাসা।” এই সময় অনুষ্কা অস্ট্রেলিয়ায় নয়, কলকাতায়। পেশাদার অভিনেত্রী। বাংলার ঝুলন গোস্বামীর বায়োপিক ” চকদা এক্সপ্রেস” সিনেমার শুটিং নিয়ে ব্যস্ত। রবিবার ম্যাচের সকাল থেকে কখনও রেড রোডের কাছে ট্রাম লাইনে আবার কখনও ময়দানের হাওড়া ইউনিয়ন ক্লাব টেন্ট চত্বরে কাজ করে গেছেন। বেলা গড়াতেই নিজের মোবাইলে চোখ রেখেছেন। ম্যাচের আপডেট নিয়েছেন। খেলা শুরু হওয়ার আগেই নাকি প্যাক আপ করিয়ে হোটেলে ফিরে যান। সূত্র মারফত জানলাম, মেক আপ না তুলেই গাড়িতে উঠে হোটেলে ছুটেছিলেন। তিনিও এক ক্রিকেটারের চরিত্র অভিনয় করছেন। স্ক্রিপ্ট পড়ে, কোহলি কাহিনীর সবটা জেনে – তিনি এই আবেগটা আটকে রাখতে চাননি। ময়দান ছেড়ে হোটেল বন্দি হয়ে ছিলেন মাঠের ব্যাট – বলের লড়াই দেখবেন বলে।
কাট টু ক্যামেরা: ৩
ফ্ল্যাশ ব্ল্যাক। স্থান : শারজা। সময়: ১৮ এপ্রিল, ১৯৮৬। টুর্নামেন্ট : অস্ট্রেলেশিয়া কাপ। ম্যাচ: ফাইনাল। প্রতিপক্ষ: ভারত – পাকিস্তান। ২৪৫ রান তাড়া করতে নেমে, ম্যাচের শেষ বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ জিতে নিয়েছিলেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। অপরাজিত ছিলেন সেঞ্চুরি করে। সেইদিন ভারতীয় দলের হয়ে খেলা তিন ক্রিকেটার – গাভাসকার ( ১৩৪ বলে ৯২ রান) , কৃষ্ণামাচারী শ্রীকান্ত ( ৮০ বলে ৭৫ রান) আর রবি শাস্ত্রী ( ব্যাটে – বোলিংয়ে সাফল্য পাননি) , এদিন মেলবোর্নে ছিলেন টিভি কমেন্ট্রি বক্সে। জয়ের রানটি নিতে দৌড় শুরু করতে মাথায় কান ঢাকা লাল টুপি পরে ছোট্ট চেহারার গাভাসকারকে ফেন্সিংয়ের ধারে, বাচ্চা ছেলের মতো হাত – পা নেড়ে নাচতে দেখা গেল। পাশে সেই শ্রীকান্ত। তিনিও এক হাতে ল্যাপটপ ব্যাগ নিয়েও লাফাচ্ছেন। শাস্ত্রী তখন কমেন্ট্রি বক্সে বসে , কাঁপছেন। পরে মাঠে নেমে আবেগের মধ্যে বিরাট কোহলিকে নানা কথা বললেন। সানি – শ্রীকান্তের সঙ্গে ইরফান পাঠানও গ্যালারিতে আনন্দে মেতেছিলেন। পাশে অন্য টিভি ক্রু’রা। সেদিন শারজায় যা করতে পারেননি সিরিজ সেরা সানি, এদিন তাই কি মিটিয়ে নিলেন!
কাট টু ক্যামেরা: ৪
ডাগ আউটে ভারতের ক্যাপ্টেন রোহিত শর্মা। ৩ বলে ১৩ রান দরকার। ক্রিজে কোহলি। সঙ্গে দীনেশ কার্তিক। অনেক আগেই নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। নড়ছেন না। চোখ ২২ গজে। ম্যাচটা আসবে তো? – এরই মধ্যে সেই বিতর্ক ঘটনা। ফ্রি হিটে কোহলি বোল্ড! বল যাচ্ছে ডিপ থার্ডম্যানে। কোহলি – ডিকে দৌড়ে তিন রান নিয়ে নিলেন। বাই ৩ রান। রোহিত নিজেও বুঝতে পারেননি কোহলি – ডিকেরা কেন দৌড়ে যাচ্ছেন! ক্যামেরায় ধরা পড়ল সেই হাবভাব। তারপর? ইতিহাস। আনন্দে ভেসে যাওয়া।
রোহিত শর্মা দৌড়ে গিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে কোহলিকে বুকে তুলে ধরলেন। ৯০ হাজারের দর্শক ঠাসা এম সি জি তখন শুধু গর্জন করেই চলেছে : ” ভি কে … ভি কে। কো … হোলি , কো … হোলি। ইন-ডিয়া, ইন-ডিয়া “। আর টিভি ক্যামেরা ধরে রয়েছে রোহিতের কোলে থাকা কোহলিকে। মাটি থেকে কয়েক ফুট উপরে রোহিতের কোলে থাকা কোহলির মনে তখন কত কিছুর ভীড়! এক লহমায়, বোঝা হয়ে গেল – আরও একবার ক্রিকেট ঈশ্বর “কোহলি কাহিনী” অন্য ভাবে লিখে রেখেছেন।
দেশের প্রধানমন্ত্রী ১৩০ কোটি দেশবাসীর জন্য দিওয়ালিতে বিশেষ উপহারের কথা শোনাতে পারেননি, অযোধ্যা থেকে। আর বিরাট কোহলি? সুদূর অস্ট্রেলিয়ার এক মাঠ থেকে ওয়াগা বর্ডারের ওপারের জয় ছিনিয়ে এনে এক অনাবিল আনন্দ সমেত বিরাট “উপহার” দিলেন দেশবাসীকে। আজ কালী পুজো। শক্তির আরাধনা। শুরু হয়ে গেছে সেই শক্তির ক্রিকেট মাঠে প্রদর্শন। কোহলি – হার্দিক – অর্শদীপরা দেখালেন পয়লা ম্যাচে। আরও পথ চলা বাকি। তারপর সেই ফাইনাল।
Leave a Reply